অসংখ্য কালজয়ী বাংলা চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী, দেশবরেণ্য কিংবদন্তী চিত্রনায়িকা । সবার অতি প্রিয় মিষ্টি মেয়েখ্যাত কবরী। এই মহান অভিনেত্রীর মহাপ্রয়াণে, শোকের মহাপ্লাবন আজ দেশ জুড়ে। বাংলা চলচ্চিত্রের অসম্ভব জনপ্রিয় অভিনেত্রী, কোটি কোটি ভক্ত-দর্শকদের শ্রদ্ধা-ভালবাসায় সিক্ত কবরী, আজ অন্তিমশয্যায় শায়িত।
মরনব্যাধি করোনার কাছে হেরে গেলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রটি। তাঁর এই চিরবিদায়ের ক্ষণে, তাঁর প্রতি অন্তিম অভিবাদন-বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ ও অসিম ভালোবাসা।
কবরী (মিনা পাল/ধর্মান্তরিত নাম সারাহ বেগম কবরী) ১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই, চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলায়, জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম শ্রীকৃষ্ণ দাস পাল, মায়ের নাম শ্রীমতি লাবণ্য প্রভা পাল।
পারিবারিকভাবে শিল্প-সংস্কৃতির আবহে বেড়ে ওঠা, কবরীর জন্মস্থান বোয়ালখালী হলেও, তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে চট্টগ্রাম নগরীতে। ১৯৬৩ সালে, মাত্র ১৩ বছর বয়সে নৃত্যশিল্পী হিসেবে মঞ্চে আবির্ভাব হয় তাঁর।
চট্টগ্রামের কৃতি সন্তান প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক সত্য সাহার মাধ্যমে ১৯৬৪ সালে, সুভাষ দত্তের পরিচালনায় ‘সুতরাং’ ছবির নায়িকা হিসেবে চলচ্চিত্রে অভিনয় জীবন শুরু হয় নায়িকা কবরীর। ব্যাপক ব্যবসায়ীক সাফল্যের পাশাপাশি ছবিটি অর্জন করেছিলো আন্তর্জাতিক পুরস্কারও। অসাভাবি সফলতার সাথে শুরু হয়, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে মিষ্টি মেয়ে কবরী অধ্যায়। তাঁর অভিনীত অন্যান্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে- বাহানা, হীরামন, সোয়ে নদীয়া জাগে পানি, নিশি হলো ভোর, সাত ভাই চম্পা, আবির্ভাব, বাঁশরি, অরুণ বরুণ কিরণমালা, শীত বসন্ত, চোরাবালি, পারুলের সংসার, প্রতিকার, ময়নামতি, আগন্তুক, নীল আকাশের নিচে, পদ্মানদীর মাঝি, মেহেরবান, নতুন ফুলের গন্ধ, যে আগুনে পুড়ি, আঁকাবাঁকা, সন্তান, নায়িকা, দ্বীপ নেভে নাই, দর্পচূর্ণ, ক খ গ ঘ ঙ, বিনিময়, রং বদলায়, কত যে মিনতি, অধিকার, ঢেউয়ের পরে ঢেউ, আপন পর, পিতা পুত্র, ঘূর্ণিঝড়, সাধারণ মেয়ে, কাঁচকাটা হীরে, জলছবি, সুখদুঃখ, গাঁয়ের বধূ, স্মৃতিটুকু থাক, শেষ রাতের তারা, কমলরাণীর দীঘি, নিজেরে হারায়ে খুঁজি, লালন ফকির, রক্তাক্ত বাংলা, রংবাজ, খেলাঘর, বলাকা মন, যাহা বলিব সত্য বলিব, কে তুমি, তিতাস একটি নদীর নাম, অনির্বাণ, আমার জন্মভুমি, অঙ্গীকার, চোখের জলে, চাবুক, উৎস্বর্গ, মাসুদ রানা, ভুল যখন ভাঙলো, বেঈমান, অবাক পৃথিবী, পরিচয়, দুইপর্ব, ত্রিরত্ন, সুজন সখী, ধন্যি মেয়ে, ডাকপিয়ন, লাভ ইন সিমলা, উপহার, জালিয়াত, চলো ঘর বাঁধি, রং বেরং, রক্তের ডাক, গুন্ডা, গোপন কথা, অনুরোধ, মতিমহল, সাগরভাসা, তৃষ্ণা, মমতা, কুয়াশা, ফরিয়াদ, রক্ত শপথ, অঙ্গার, আগুনের আলো, সারেং বৌ, বধু বিদায়, দিন যায় কথা থাকে, মধুমতি, ছোট মা, আরাধনা, শহর থেকে দূরে, ঈমান, নওজোয়ান, সোনার হরিণ, সোনার তরী, কলমীলতা, লাল সবুজের পালা, স্বামীর সোহাগ, দেবদাস, আরশি নগর, আশা, প্রেমবন্ধন, সোনালী আকাশ, দুই জীবন, চেতনা, ছোট বৌ, লাখে একটা, দয়ামায়া, অপরাজিত নায়ক, দেমাগ, বিয়ের ফুল, আামাদের সন্তান, জীবনের গল্প, আয়না, মেঘের কোলে রোদ, পিতা মাতার আমানত, তুমি আমার স্বামী, ইত্যাদি।
চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য নায়িকা কবরী যেসব পুরস্কার পেয়েছেন তাঁরমধ্যে উল্লেখযোগ্য- জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী, ছবি-সারেং বৌ-১৯৭৮, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার আজীবন সম্মাননা-২০১৩। বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী, ছবি- লালন ফকির-১৯৭৩, সুজন সখী-১৯৭৫, সারেং বৌ-১৯৭৮, দুই জীবন-১৯৮৮ ও বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার আজীবন সম্মাননা-২০০৯। এছাড়াও প্রযোজক সমিতি চলচ্চিত্র পুরস্কার’সহ বিভিন্ন সংগঠন কর্তৃক নানা পদক ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি।
নায়িকা কবরী টেলিভিশন নাটকেও অভিনয় করেছেন। তিনি চলচ্চিত্র পরিচালনাও করেছেন। তাঁর পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আয়না’, মুক্তি পায় ২০০৬ সালে। সরকারি অনুদানে ‘এই তুমি সেই তুমি’ নামে আরেকটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করছিলেন তিনি। এই ছবিটির শুটিং শেষ করে, সম্পাদনার কাজ করছিলেন।
নায়িকা কবরী এক সময় সরাসরি রাজনীতিতে আসেন। ‘বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট’-এর প্রথম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। এখন এর একাংশের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। ২০০৮ সালে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে, জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০১৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
২০১৭ সালে, অমর একুশে গ্রন্থমেলায় কবরী’র আত্মজীবনীমূলক বই ‘স্মৃতিটুকু থাক’ প্রকাশিত হয়। ব্যক্তিগত জীবনে কবরী, দুইবার বিয়ে করেছেন। প্রথম বিয়ে করেন চলচ্চিত্র প্রযোজক চিত্ত চৌধুরীকে। কিছুদিন পর তাঁর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। পরে ১৯৭৮ সালে, কবরী, বগুড়ার এক দরবেশের কাছে গিয়ে, ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন এবং সেখানেই তিনি সফিউদ্দীন সরোয়ার বাবুর সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন । দীর্ঘ ৩০ বছর সংসার করার পর, ২০০৮ সালে তাঁদেরও বিচ্ছেদ হয়ে যায়। কবরী-সরোয়ার দম্পতির পাঁচ ছেলে সন্তান রয়েছে।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পের ইতিহাসের অন্যতম স্তম্ভ ছিলেন কবরী। বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধেও ছিল তাঁর অসামান্য অবদান। এই মহীয়সী নারীর অনন্ত যাত্রায়, তাঁর বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করছি।