এ কে আজাদ: খান জয়নুল। অভিনেতা। কিংবদন্তীতুল্য কৌতুক অভিনেতা। বহুল জনপ্রিয় এই অভিনেতা, বেশীরভাগ ছবিতে কৌতুকাভিনয় করলেও, কোনো কোনো ছবিতে তিনি সহনায়ক ও আবেকঘন-গুরত্বপুর্ণ চরিত্রেও অভিনয় করেছেন কৃতিত্বের সাথে। তাঁর অভিনয় প্রতিভা, তাঁর সংলাপ বলার ধরণ, ক্ষেত্রবিশেষে নিজের সংলাপ নিজেই তৈরি করা, তাঁর দৃশ্য অনুযায়ী নিজের মানানসই পোশাক নির্বাচন করা, একজন কৌতুক অভিনেতা হিসেবে এসব বিষয়গুলো তাঁকে অন্যান্য অনেকের থেকে আলাদাভাবেই আবিষ্কৃত করে। শিল্পের বিভিন্ন শাখায় কাজ করেছেন খান জয়নুল, সর্বোপরি উনি একজন পরিপূর্ণ শিল্পী ছিলেন। সহশিল্পীর প্রতি সহযোগিতা পরায়ণ এই মানুষটি, চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টদের কাছে একজন উদার মনের ভালো মানুষ হিসেবেও সমাদৃত ছিলেন।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কৌতুক সম্রাট খান জয়নুল-এর মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৭৮ সালের ১৫ জানুয়ারী, মাত্র ৪২ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। প্রয়াত এই গুণী অভিনয়শিল্পীর স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা। তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি প্রার্থনা করি।
তখনকার সময়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা এই অভিনেতা ১৯৩৬ সালের ৪ জুলাই, মুনশীগঞ্জের লৌহজং থানার রানাদিয়া গ্রামে, জন্মগ্রহন করেন। তাঁর বাবার মরহুম আজহারউদ্দিন খান ছিলেন ব্যবসায়ী আর মা মরহুমা মোমেলা খাতুন গৃহিণী। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন খান জয়নুল। ছোটবেলা থেকে তাঁর অভিনয় করার শখ ছিল। ছোটবেলায় তিনি নিজেই বাইস্কোপ বানাতেন এবং নিজেই গান রচনা করে গ্রামের ছেলেদের দেখাতেন।
১৭ বছর বয়সে যখন গোপালগঞ্জের এক স্কুলে পড়তেন তখন তিনি নাটকে প্রথম অভিনয় শুরু করেন। ক্রমেই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। এক সময় কলকাতায় চলে যান ছবিতে অভিনয় করার উদ্দেশ্যে। খান জয়নুল- নাম পরিবর্তন করে ‘মৃণাল কান্তি রায়’ নামে কোলকাতার কিছু ছবিতে ছোটখাট চরিত্রে অভিনয় করেন।
দেশ ভাগের পর তিনি চলে আসেন ঢাকায়। এখানে এসে মঞ্চে নিয়মিত অভিনয় করার পাশাপাশি নাটক লেখালেখি শুরু করেন। কিছুদিন তিনি সাংবাদিকতাও করেছেন সাপ্তাহিক ‘পূবালী’ পত্রিকায়।
ঢাকার চলচ্চিত্রে তাঁর প্রথম আবির্ভাব ঘটে মুস্তাফিজ পরিচালিত ‘তালাশ’ (উর্দু) ছবির মাধ্যমে। তুমূল জনপ্রিয় অভিনেতা খান জয়নুল অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর মধ্যে- সুতরাং, দুই দিগন্ত, শীত বিকেল, আগুন নিয়ে খেলা, ১৩নং ফেকু ওস্তাগার লেন, সখিনা, সাইফুল মুল্ক বদিউজ্জামাল, মধুমালা, সপ্তডিংগা, ময়নামতি, কাঁচ কাটা হীরে, সন্তান, পদ্মা নদীর মাঝি, দর্পচূর্ণ, যে আগুনে পূড়ি, মিশরকুমারী, অন্তরঙ্গ, নীল আকাশের নীচে, মায়ার সংসার, রং বদলায়, মধু মিলন, ঢেউয়ের পর ঢেউ, নায়িকা, আদর্শ ছাপাখানা, মাটির মায়া, অশান্ত ঢেউ, দিনের পর দিন, স্মৃতি তুমি বেদনা, নাচের পুতুল, পীচ ঢালা পথ, মিশর কুমারী, নায়িকা, রং বদলায়, অন্তরঙ্গ, ত্রিরত্ন, ইয়ে করে বিয়ে, ঝড়ের পাখি, মানুষের মন, দাসী, অবুঝ মন, ছন্দ হারিয়ে গেলো, প্রতিশোধ, পায়ে চলার পথ, সাধারণ মেয়ে, দীপ নিভে নাই, কে তুমি, সতী নারী, জীবন তৃষ্ণা, মাসুদ রানা, চোখের জলে, বেঈমান, টাকার খেলা, আদর্শ ছাপাখানা, আলোর মিছিল, হারজিৎ, কার হাসি কে হাসে, সাধু শয়তান, অনেক প্রেম অনেক জ্বালা, ফেরারি, আগুন, আঁধারে আলো, বাদী থেকে বেগম, দূর থেকে কাছে, ভুল যখন ভাঙ্গলো, পরিচয়, দুই পর্ব, জীবন সাথী, পিঞ্জর, সন্ধিক্ষণ, ডাক পিওন, আদালত, গোপাল ভাঁড়, দিওয়ানা, স্মৃতি তুমি বেদনা প্রভৃতি অন্যতম।
চলচ্চিত্রের পাশাপাশি তিনি টেলিভিশনের নাটকেও অভিনয় করেছেন নিয়মিত। তখনকার সময়ে টেলিভিশনের অত্যন্ত জনপ্রিয় সিরিজ নাটক ‘ত্রিরত্ন’তে খান জয়নুল ‘চুনি’ চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের মাঝে আজও অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন।
নাট্যকার হিসেবেও খান জয়নুল যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাঁর লেখা হাসির নাটক ‘শান্তিনিকেতন’ মঞ্চস্থ হলে তখনকার সময়ে দর্শকদের অকুন্ঠ প্রশংসা অর্জন করে। ‘ঘর মন জানালা’ তাঁর রচিত একটি জনপ্রিয় নাটক ছিল। ‘১৩নং ফেকুওস্তাগার লেন’ চলচ্চিত্রটির কাহিনি ও সংলাপ রচয়িতাও ছিলেন তিনি।
খান জয়নুল ১৯৭০ সালের ৮ নভেম্বর, রিজিয়া খান এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ২০২০ সালের ১৭ আগস্ট রিজিয়া খান ইন্তেকাল করেন। তাদের দুই ছেলে সন্তান রয়েছে। বড় ছেলে রাশেদ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর খান (বুলেট), পেশায় আর্কিটেক্ট। ছোট ছেলে রাসেল মোহাম্মদ আলমগীর খান (টোটা), বেক্সিমকোতে বিভাগীয় ম্যানেজার পদে চাকরি করেন। বর্তমানে তাঁরা মিরপুর ১১ নম্বরে, নিজস্ব বাসায় বসবাস করেন।
শিল্প-সাংস্কৃতিক অংগনের বিরল প্রতিভার অধিকারী খান জয়নুল ছিলেন একাধারে নাট্যসংগঠক, মঞ্চ-বেতার ও টিভি অভিনেতা, নাট্যকার, কাহিনী ও সংলাপ লেখক। সর্বোপরি একজন উচুমানের অভিনেতা। বিশেষ করে কৌতুক চরিত্রের এই জাত অভিনেতা, কৌতুককে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায় । বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে কৌতুককে শিল্প পর্যায় করেছেন উন্নীত। যা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে অনন্তকাল ।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কৌতুক সম্রাট খান জয়নুল অনন্তলোকে ভালো থাকুন- এই প্রার্থণা করি।