এ কে আজাদ: আলী যাকের। অভিনেতা-নাট্যকার-নির্দেশক। তিনি একজন সৃজনশীল অভিনেতা-নাট্যকার- নির্দেশক-লেখক, স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব । বহুমাত্রিক প্রতিভায় ভাস্বর একজন পূর্ণসফল মানুষ। অত্যন্ত সহজ সরল জীবন যাপন করে গেছেন, পেয়েছেন দেশের মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা।
এই প্রতিভাবান বরেণ্য সাংস্কৃতিকব্যক্তিত্ব আলী যাকের-এর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী আজ । তিনি ২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। প্রয়াত এই গুণিজনের স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
আলী যাকের ১৯৪৪ সালের ৬ নভেম্বর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগরের রতনপুর ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম মাহমুদ তাহের ও মা রেজিয়া তাহের। বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে তাঁর শৈশব কেটেছে কুষ্টিয়া ও মাদারীপুরে ।
আলি যাকের ১৯৬০ সালে ‘সেন্ট গ্রেগরিজ উচ্চবিদ্যালয়’ থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। পরবর্তীতে ঢাকার ‘নটর ডেম কলেজ’ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে’ ভর্তি হন এবং সেখান থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সাথে যুক্ত ছিলেন। আলি যাকের ১৯৬৪ সনে ‘ছায়ানট’র সাথে নিজেকে যুক্ত করেন।
১৯৭১ সালে আমদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন আলী যাকের। তিনি ছিলেন ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে’র শব্দসৈনিক।
আলী যাকের ১৯৭২ সালে ‘আরণ্যক’ নাট্যদলের হয়ে মামুনুর রশীদের নির্দেশনায়, মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন। ১৯৭২ সালেই তিনি ‘নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়’-এ যোগ দেন। এই দলের হয়ে তিনি প্রথম অভিনয় করেন আতাউর রহমানের নির্দেশনায় ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নাটকে।
১৯৭৩ সালে ‘নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ে’র হয়ে তিনি প্রথম নির্দেশনা দেন ‘বাকি ইতিহাস’ নাটকটি, যা ছিল বাংলাদেশে প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাট্য প্রদর্শনী।
‘ব্রেটল ব্রেশটের দ্য লাইফ অব গ্যালিলিও গ্যালিলি’ অবলম্বনে ‘গ্যালিলিও’ নামে অনুবাদ করা নাটকে ‘গ্যালিলিও’ চরিত্রে অভিনয়ের করে আলী যাকের ‘বাংলার গ্যালিলিও’ হিসেবে সুবিখ্যাত হয়ে আছেন।
তাঁর আরো কিছু বিখ্যাত মঞ্চনাটকের মধ্যে আছে- দেওয়ান গাজীর কিসসা, ম্যাকবেথ, নুরুলদীনের সারাজীবন, অচলায়তন, বিদগ্ধ রমণীকুল, তৈল সংকট, এই নিষিদ্ধ পল্লীতে, সৎ মানুষের খোঁজে, কোপেনিকের ক্যাপ্টেন, কবর দিয়ে দাও, প্রভৃতি ।
আলী যাকের মঞ্চের পাশাপাশি অভিনয়ে নিয়মিত হন টেলিভিশননাটকেও। তাঁর অভিনীত নাটকগুলোর মধ্যে- একদিন হঠাৎ, বহুব্রীহি, পাগড়ি, অচিন বৃক্ষ, ধিক লক্ষবার, পান্ডুলিপি, গণি মিয়ার পাথর, ঘোড়সরয়ারের স্বপ্ন, পিছুটান, নীতু তোমাকে ভালোবাসি, বাবা ও ঈদ, পাথর সময়, তথাপি, দেয়াল, স্পেশাল গেস্ট, আইসক্রিম, আজ রবিবার, ভালোবাসি তাই, উল্লেখযোগ্য।
হুমায়ূন আহমেদের ‘বহুব্রীহি’ নাটকে ‘মামা’র চরিত্রে অভিনয় করে পুরো বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেন আলী যাকের। এরপরে যতদিন গেছে তাঁর জনপ্রিয়তা বেড়েছেই শুধু। বহু নাটকে নানা ধরণের চরিত্রে অভিনয় করেছেন আলী যাকের, সব চরিত্রকেই তিনি ভিন্নমাত্রায়, ভিন্ন আঙ্গিকে রূপায়ন করেছেন তাঁর বহুমাত্রিক অভিনয় প্রতিভার মাধ্যমে। নিজ অভিনয় প্রতিভার গুণে তিনি নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন অনন্য এক উচ্চতায়।
অল্প সংখ্যক চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন আলী যাকের । স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আগামী’ ও ‘হুলিয়া’সহ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র- নদীর নাম মধুমতি, লালসালু, বৃষ্টি (মুক্তদৈর্ঘ্য), রাবেয়া ছবিতেও অভিনয় করেছেন।
টেলিভিশনের জন্য অনেক মৌলিক নাটক লিখেছেন তিনি। সমসাময়িক বিষয়ে পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখিও করতেন। প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা বইও- ‘সেই অরুণোদয় থেকে’ ও ‘নির্মল জ্যোতির জয়’সহ কয়কটি বই। একজন শৌখিন আলোকচিত্রীও ছিলেন তিনি। যুক্তরাজ্যের রয়েল ফটোগ্রাফিক সোসাইটির পূর্ণ সদস্য ছিলেন।
‘মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম একজন আলী যাকের। এ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলতে আন্তরিকভাবে নিবেদিত ছিলেন তিনি।
তিনি এদেশের বিজ্ঞাপন শিল্পেরও অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। আমাদের দেশের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞাপনী সংস্থা ‘এশিয়াটিক’র কর্ণধার ছিলেন তিনি।
শিল্পকলায় বিশেষ অবদানের জন্য আলী যাকেরকে ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার, দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘একুশে পদক’-এ ভূষিত করে। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী পদক, নরেন বিশ্বাস পদক, সেলিম আল দীন পদক এবং মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পুরস্কার লাভ করেন।
ব্যাক্তিজীবনে আলী যাকের ১৯৭৭ সালে, সুঅভিনেত্রী সারা যাকেরের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির দুই সন্তান, পুত্র অভিনেতা ইরেশ যাকের ও কন্যা শ্রিয়া সর্বজয়া।
আমাদের দেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যাক্তিত্বদের একজন তিনি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এ দেশে মঞ্চ নাটকের আধুনিকায়নে যাঁরা ভুমিকা রেখেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন তিনি। দেশবরেণ্য অভিনেতা, নাট্য সংগঠক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তথা শিল্প-সংস্কৃতির সৃজনশীল মেধাবী মানুষ আলী যাকের স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে থাকবেন অনন্তকাল।