একে আজাদ: আহমেদ রুবেল। অভিনেতা। একজন প্রতিভাবান মেধাবী অভিনেতা ছিলেন । সুঠাম দেহ আর ভরাট কন্ঠের এক শক্তিমান অভিনেতা, যিনি তাঁর বলিষ্ট অভিনয়ে প্রতিটি চরিত্রকে করে গেছেন জীবন্ত। চেহারা নয়, একজন উঁচুমানের গুণী অভিনেতা হিসেবে পেয়েছেন জনপ্রিয়তা। বাংলাদেশের নাটক ও চলচ্চিত্রে এমন কিছু চরিত্রে তিনি রূপ দান করে গেছেন, যা যুগের পর যুগধরে তাঁর প্রতিনিধিত্ব করবে।
প্রতিভাবান গুণী অভিনেতা আহমেদ রুবেল-এর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০২৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারী, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর। প্রয়াত এই গুণি অভিনেতার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
আহমেদ রুবেল (আহমেদ রেজা রুবেল) ১৯৬৮ সালের ৩ মে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের রাজারামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আয়েশ উদ্দিনের চাকরীর সুবাদে পরিবারের সঙ্গে গাজীপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ‘রাণী বিলাসমনি সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়’ থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন রুবেল। তারপর স্থানীয় ‘ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ’য়ে পড়ালেখা শেষে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে ভর্তি হন ‘জগন্নাথ কলেজ’য়ে এখান থেকে মাস্টার্স শেষ করেন।
চার বোন দুই ভাইয়ের মধ্যে আহমেদ রুবেল ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর বড় ভাই ডাক্তার খালেদ শামসুল ইসলাম ডলার (স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র ডেপুটি চিফ ছিলেন) ২০১২ সালের ১২ মে, মৃত্যুবরন করেন।
ছোটবেলা থেকে অভিনয়ের প্রতি আসক্ত রুবেল ঢাকায় এসে যুক্ত হন জনপ্রিয় থিয়েটার দল ‘ঢাকা থিয়েটার’-এ।
ঢাকা থিয়েটারের হয়ে সে অভিনয় করেছে- কেরামত মঙ্গল, হাত হদাই, বন পাংশুল, কিত্তনখোলা, একাত্তরের পালা, মার্চেন্ট অব ভেনিস, বনঘাসফুল, যৈবতী কন্যার মনসহ অনেক নাটকে।
নাট্যপরিচালক আতিকুল হকের মাধ্যমে রুবেল টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করা শুরু করেন। তাঁর অভিনীত প্রথম নাটক গিয়াস উদ্দিন সেলিমের রচনায় ‘স্বপ্নযাত্রা’। আহমেদ রুবেল আরো যেসব নাটকে অভিনয় করেছেন তারমধ্যে- একতারা দোতারা, পুষ্পকথা, মায়েশা, খোয়াবনগর, রঙের মানুষ, কাবুলিওয়ালা, সবাই গেছে বনে, বৃক্ষমানব, বলবান জামাতা, শত্রু, অতিথি, দ্বন্দ্ব সমাস, যমুনার জল দেখতে কালো, মৃত্তিকার মন, স্বপ্নমানুষ, স্বপ্ন ও বাস্তবতা, অচিন রাগিনী, ওপেনটি বায়োস্কোপ, ছায়া ও কায়া, শার্ট, দ্বিতীয় জীবন, তুমি শুধু আমার, কবি ও কবিতা, সাহিত্যিকের বউ, দূর পাহাড়ের বাতাসেরা, সিঁদ কাটা চোর, ভুলে ভেসে কূলে আসা, শূন্যস্থান পূর্ণ, বারোটা বাজার আগে, নকশীপাড়ের মানুষেরা, বিশ্বাস, রাজুর সাগর দেখা, এ জার্নি বাই বোট, জোছনা ও রহিমের কিছু দৃশ্যকল্প, স্বরে অ, খুন, মেঘরঙ মেয়ে, কাছের খুব দূরে, ঢাকা, চেয়ার, স্বর্ণকলস, পাথর, অতল, আয়েশার ইতিকথা, বৃক্ষমানব, পুষ্পকথা, বদলি সুরত, দূরের বাড়ি কাছের মানুষ, সৈয়দ বাড়ির বউ উল্লেখযোগ্য।
মঞ্চ ও ছোট পর্দার অভিনেতা আহমেদ রুবেল এক সময় নায়ক হয়ে পা রাখেন রুপালি পর্দায় অর্থাৎ চলচ্চিত্রে। তাঁর অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আখেরী হামলা’ মুক্তিপায় ১৯৯৪ সালে, চলচ্চিত্রে তাঁর পর্দানাম ছিলো মুরাদ হাসান।
পরে তিনি আরো অভিনয় করেছেন- আজকের ফয়সালা, মুক্তির সংগ্ৰাম, রঙিন রংবাজ, কে অপরাধী?, সাবাস বাঙালী, চন্দ্রকথা, ব্যাচেলর, শ্যামল ছায়া, মেঘলা আকাশ, পৌষ মাসের পিরীত, গেরিলা, দ্য লাস্ট ঠাকুর, জোনাকির আলো, জ্বীন-২, লালমোরগের ঝুঁটি, চিরঞ্জীব মুজিব, অলাতচক্র, পারাপার (কলকাতা) পেয়ারার সুবাস প্রভৃতি চলচ্চিত্রে।
চলচ্চিত্র পুরস্কার বিভাগে ২০০৪ সালে ‘চন্দ্রকথা’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য, ৬ষ্ঠ মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র অভিনেতা (সমালোচক) বিজয়ী হয়েছিলেন আহমেদ রুবেল।
ব্যক্তিজীবনে আহমেদ রুবেল তাঁর সহশিল্পী অভিনেত্রী তারানা হালিমকে বিয়ে করেন, সেই বিয়ে একসময় বিচ্ছেদে রূপ নেয়। পরে মনোয়ারা বেগম নামে এক মেয়েকে বিয়ে করেন রুবেল। তাঁর কোনো সন্তান নেই।
একজন প্রতিভাবান মেধাবী অভিনেতা ছিলেন আহমেদ রুবেল। অভিনয়ের শুরুটা মঞ্চ, আর এই মঞ্চে অনেক কালজয়ী সব নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি । দীর্ঘদেহী এই অভিনেতার ভরাটকন্ঠ মঞ্চ কাঁপিয়েছে অনেক দিন।
এরপর চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেছিলেন নায়ক হিসেবে। নায়ক হয়ে তেমন একটা সুবিধা না করতে পারলেও, খল নায়ক হিসেবে দারুণ আশার আলো দেখিয়ে ছিলেন। কিন্তু সে সময়েই চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা জেঁকে বসে, আর তখন রুবেল বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে অভিনয়কে বিদায় জানান। টিভিনাটক আর ভিন্নধারার চলচ্চিত্রে নিজের অভিনয় প্রতিভার দ্যূতি ছড়ানো শুরু করেন।
দীর্ঘদেহ ও বলিষ্ট কন্ঠের অধিকারী হয়ে বাংলাদেশে যে কয়েকজন অভিনেতা বিশেষভাবে, অভিনয় প্রতিভার দ্যূতি ছড়িয়েছেন, তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন।
তিনি অভিনয় প্রতিভার মাপকাঠিতে দর্শকপ্রিয় একজন অসাধারণ অভিনয়শিল্পী হয়ে উঠতে পেড়েছিলেন। বিনয়ী, নম্র-ভদ্র দরাজ কন্ঠের অধিকারী আহমেদ রুবেল বাংলাদেশের দর্শকদের স্মৃতিতে চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবে।