প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ, চলচ্চিত্র পরিচালক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কলিম শরাফী’র দশম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ২ নভেম্বর, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। প্রয়াত এই বরেণ্য ব্যক্তিত্বের প্রতি জানাই বিন্ম্র শ্রদ্ধা। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
কলিম শরাফী (মাখদুমজাদা শাহ সৈয়দ কলিম আহমেদ শরাফী) ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৮ মে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার, সিউরী সদর মহকুমার অন্তর্গত, খয়রাদিহি গ্রামে, এক বিখ্যাত পীর বংশে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম সামি আহমেদ শরাফী এবং মাতার নাম মোসামৎ আলিয়া বেগম।
১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পাঠশালায় ভর্তি হয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। তাঁতিপাড়া প্রাইমারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করে চলে আসেন কলকাতায়, বাবা সামি আহমেদ শরাফীর কাছে। সেখানে ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ভর্তি হন মাদ্রাসা-ই-আলিয়াতে। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে, কলিম শরাফী ভর্তি হন, হেতমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে। কিন্তু নানারকম প্রতিকূল অবস্থায়, তাঁর আর বেশী লেখাপড়া করা হয়নি।
কলিম শরাফী কলকাতার বিখ্যাত সঙ্গীত বিদ্যালয় ‘দক্ষিণী’ থেকে (১৯৪৬-১৯৫০) পর্যন্ত সঙ্গীত শিক্ষা লাভ করেন। এরপর সেখানে শিক্ষকতা করেন।
১৯৪৬-এ বিখ্যাত গ্রামোফোন কোম্পানি এইচএমভি থেকে বের হয় কলিম শরাফীর প্রথম গণসঙ্গীতের রেকর্ড। সেই সময়েই নিয়মিত কন্ঠশিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন কলকাতা বেতারে।
১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করেন। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে, ঢাকা ছেড়ে তিনি চলে যান চট্টগ্রামে। সেখানে গড়ে তোলেন, প্রান্তিক নামে একটি সংগঠন। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকে তিনি আবার ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকায় ‘হ-য-ব-র-ল’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এ সংগঠনের ব্যানারেই মঞ্চস্থ করেন ‘তাসের দেশ’ নাটকটি।
তিনি ১৯৬৪-৬৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পাকিস্তান টেলিভিশনে প্রোগ্রাম ডাইরেক্টর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯-৭২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পাকিস্তান গ্রামোফোন কোং লিঃ এর পরিচালক ও জেনারেল ম্যানেজার হিসাবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৪-৭৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস কর্পোরেশন এর চীফ ইনফরমেশন অফিসার ও জেনারেল ম্যানেজার পদে দায়িত্ব পালন করেন।
কলিম শরাফী ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে, সত্যেন সেনের সঙ্গে উদীচীর কর্মকাণ্ডে যোগ দেন এবং ১৯৭৭ থেকে প্রায় অনেকগুলো বছর সভাপতি ও সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ সালে গঠিত হয় ‘জাহিদুর রহিম স্মৃতি পরিষদ’। কলিম শরাফী ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক । পরে এই ‘জাহিদুর রহিম স্মৃতি পরিষদ’ই ‘জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ’-এ পরিণত হয়।
কলিম শরাফী ১৯৮৩ সালের এপ্রিলে ‘সঙ্গীত ভবন’ নামে একটি সঙ্গীত বিদ্যালয় গড়ে তোলেন। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই তিনি এ প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি শিল্পকলা একাডেমি কাউন্সিল ও শিশু একাডেমি কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া বাংলাদেশ বেতার-টিভি শিল্পী সংস্থা, বাংলাদেশ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংস্থা ও নাগরিক নাট্য অঙ্গনের সভাপতি ছিলেন।
সুদীর্ঘ সঙ্গীতজীবনে কলিম শরাফীর পনেরোটি গানের ক্যাসেট ও তিনটি সিডি প্রকাশিত হয়েছে৷ স্মৃতি অমৃত- নামে তাঁর লেখা একটি গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে ৷
কলিম শরাফী চলচ্চিত্রেও গান গেয়েছেন। তিনি যেসব ছবিতে নেপথ্য কন্ঠ দেন সেগুলো হলো- মাটির পাহাড়, সূর্যস্নান, মেঘের অনেক রং, ধারাপাত, গোধূলির প্রেম, কখনো আসেনি, সোনার কাজল, আকাশ আর মাটি, মোহনা প্রভৃতি।
তিনি, পরিচালক জহির রায়হানের সংগে যৌথভাবে ‘সোনার কাজল’ নামে একটি ছবিও পরিচালনা করেন। জানা যায়, কলিম শরাফীর সঙ্গীত পরিচালনায় নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার অর্জন করে। এছাড়া কবিয়াল রমেশ শীলের জীবন নিয়ে একটি তথ্যচিত্রও নির্মাণ করেন কলিম শরাফী।
সঙ্গীতশিল্পে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ কলিম শরাফী বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হন। এরমধ্যে আছে- একুশে পদক (১৯৮৫), স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৯), নাসিরউদ্দিন স্বর্ণ পদক (১৯৮৮), বেগম জেবুন্নেছা ও কাজী মাহবুব উল্লাহ স্বর্ণ পদক (১৯৮৭), সত্যজিৎ রায় পুরস্কার (১৯৯৫), শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র হতে কৃতি বাঙালি সম্মাননা পদক (১৯৮৮), বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ, রবীন্দ্র সুবর্ণ জয়ন্তী পাটনা, কলকাতার শিল্প মেলার বঙ্গ সংস্কৃতি, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, সিকোয়েন্স সম্মাননা পদক, রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী পদক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় গুণিজন সংবর্ধনা, বাংলা একাডেমি প্রবর্তিত- রবীন্দ্র পুরস্কার-২০১০।
ব্যক্তিজীবনে কলিম শরাফী ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে, বিয়ে করেন কামেলা খাতুনকে। প্রথমস্ত্রীর সাথে ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে বিচ্ছেদ ঘটার পর ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে, দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন, অধ্যাপিকা নওশেবা খাতুনকে। কলিম শরাফীর দুই সন্তান, নাম আলেয়া শরাফী এবং আজিজ শরাফী।
সঙ্গীতজ্ঞ-কন্ঠশিল্পী-চলচ্চিত্র পরিচালক কলিম শরাফী । তিনি ছিলেন বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পী, দেশাত্মবোধক গানের ক্ষেত্রেও তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি রয়েছে। সঙ্গীতের বাইরে তিনি ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িত রেখেছিলেন।
সঙ্গীত-চলচ্চিত্র-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভুবনের এই বরেণ্য গুণি মানুষটি, চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন, আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক ইতিহাসে।
(তথ্যসূত্র ও ছবি- ইন্টারনেট থেকে নেয়া)
সাবস্ক্রাইব
নিরাপদ নিউজ আইডি দিয়ে লগইন করুন
0 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরাতন