এ কে আজাদ: আফজাল চৌধুরী। চলচ্চিত্রগ্রাহক। একজন সৃজনশীল মেধাবী চলচ্চিত্রগ্রাহক হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন । চলচ্চিত্র চিত্রায়নে শৈল্পিক দক্ষতায় ঋদ্ধ ছিলেন তিনি। বহু চলচ্চিত্র মূর্ত হয়ে আছে তাঁর চিত্রগ্রহণের ব্যতিক্রমী সৃজনশীলতা। একজন উচুমানের চিত্রগ্রাহক হিসেবে তাঁর ছিল সুপরিচি ও সুনাম।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পে একজন প্রথিতযশা চিত্রগ্রাহক হিসেবে ছিলেন বিরাজমান। এই প্রখ্যাত চলচ্চিত্রগ্রাহক এর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০২৩ সালের ৩১ আগষ্ট, ঢাকার ইউনাইটেড হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯২ বছর । প্রয়াত এই গুণী চলচ্চিত্রব্যক্তিত্বের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।
আফজাল চৌধুরী (আফজাল হোসেন চৌধুরী) ১৯৩১ সালের ৩১ অক্টোবর, বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই ফটোগ্রাফীতে মনোযোগী ছিলেন। ১৯৫০ সালে বোম্বে যান চলচ্চিত্রে কাজ করার ইচ্ছে নিয়ে। সেখানে বিখ্যাত চিত্রগ্রাহক ভ্রাতৃদ্বয় জাল মিস্ত্রি ও ফলি মিস্ত্রি’র সাথে কাজ শেখেন তিনি। এরপর লাহোর ও করাচিতে কাজ করেন। আফজাল চৌধুরী ১৯৬১ সালে চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের চিঠি পেয়ে ঢাকায় আসেন তাঁর ‘কাচের দেয়াল’ চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রহণ করার জন্য। এটিই ঢাকায় তাঁর প্রথম চিত্রায়িত চলচ্চিত্র। এরপর এদেশের বহু ছবির চিত্রগ্রহণ করেছেন ।
আফজাল চৌধুরী চিত্রায়িত চলচ্চিত্রসমূহের মধ্যে- কাচের দেয়াল, সঙ্গম, অনেক দিনের চেনা, এইতো জীবন, মিলন, বাহানা, কাজল, জানাজানি, বেগানা, আপন দুলাল, কার বউ, আলী বাবা, আয়না ও অবশিষ্ট, নয়নতারা, কারওয়াঁ, শেষ পর্যন্ত, বাঁশরী, মনের মত বউ, পিয়াসা, চেনা অচেনা, জীবন থেকে নেয়া, জ্বলতে সুরুজ কি নীচে (প্রযোজকও), আপোষ, সোহরাব রুস্তম প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
তৎকালীন উভয় পাকিস্তানের প্রথম আংশিক রঙ্গীন ‘গুলে বাঁকালি’ (১৯৬১), প্রথম এক শটের গানের ‘ওয়াফা কি ইয়াদা’, বাংলাদেশের প্রথম ‘লো-কি’ সিনেমাটোগ্রাফি ‘কাঁচের দেয়াল’ (১৯৬৩), প্রথম সম্পুর্ণ রঙ্গীন চলচ্চিত্র ‘সঙ্গম’ (১৯৬৪), প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র ‘বাহানা’ (১৯৬৫), প্রথম ‘ট্রিপল রোল’-এর চলচ্চিত্র ‘জ্বলতে সুরুজ কে নিচে’ (১৯৭০)/’উজ্জ্বল সূর্যের নীচে’, ১৯৭৭), প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০), পাকিস্তানের সবচেয়ে ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র ‘আয়না’- এমনসব রেকর্ড গড়া চলচ্চিত্র চিত্রায়িত হয়েছে গুণী চিত্রগ্রাহক আফজাল চৌধুরী দ্বারা।
এমন একজন বিখ্যাত নান্দনিক চলচ্চিত্রগ্রাহক হয়েও তিনি তাঁর প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত থেকেছেন আজীবন। কী এক অজানা কারণে তাঁকে জাতীয় বা রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করা হয়নি- মূল্যায়ন করা হয়নি। তবে এদেশের বিকল্প চলচ্চিত্র আন্দোলন, আফজাল চৌধুরীকে সম্মান জানিয়েছিল। আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ও মুক্ত চলচ্চিত্র উৎসব ২০১৬ সালে, তাঁকে ‘হীরালাল সেন স্মারক সম্মাননা পদক’ প্রদান করে।
আমাদের চলচ্চিত্রের প্রথিতযশা এই আলোকচিত্রশিল্পী আফজাল চৌধুরীর স্ত্রী সুরাইয়া আফজাল ও দুই কন্যা নিয়ে ছিল তাঁর সংসার। অত্যন্ত গুণী এই চলচ্চিত্রগ্রাহক, চলচ্চিত্র সম্পর্কে তাঁর অর্জিত জ্ঞান ও শিক্ষা দিয়ে, এদেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে সমৃদ্ধ করে গেছেন আজীবন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। বিনয়ী ভদ্র ও অত্যন্ত ভালো মানুষ হিসেবে চলচ্চিত্ররসংশ্লিষ্টদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন আফজাল চৌধুরী।