আজাদ আবুল কাশেম: ড. ইনামুল হক অভিনেতা, লেখক, নাট্যকার, নির্দেশক ও শিক্ষক। বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনের প্রথিতযশা ও আলোকিত মানুষ তিনি। মেধা ও মননশীলতার প্রতিক, সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের নাট্যান্দোলনের অগ্রপথিকদের অন্যতম একজন তিনি। দেশের সুস্থধারার শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশে রেখে গেছেন অনন্য ভূমিকা।
এই মেধাবী নাট্যব্যক্তিত্ব ও অভিনেতা ড. ইনামুল হক এর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০২১ সালের ১১ অক্টোবর, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। প্রয়াত এই গুণী মানুষটির স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
ড. ইনামুল হক ১৯৪৩ সালের ২৯ মে, ফেনী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ওবায়দুল হক ও মা’য়ের নাম রাজিয়া খাতুন। ফেনী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও ঢাকার নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। ১৯৭৬ সালে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
ড. ইনামুল হক ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) রসায়ন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭০ সালে সহকারী অধ্যাপক, ১৯৭৯ সালে সহযোগী অধ্যাপক এবং ১৯৮৭ সালে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। দীর্ঘ ১৫ বছর রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২ বছর প্রকৌশল অনুষদের ডিন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
ড. ইনামুল হক, ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য । এই দলের হয়ে তিনি প্রথম মঞ্চে অভিনয় শুরু করেন, তাঁর অভিনীত প্রথম নাটক ছিল আতাউর রহমানের নির্দেশনায় ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো’। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াসে বিভিন্ন আন্দোলনমুখী নাটকে অভিনয় করেন। পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে সৃজনীর ব্যানারে ট্রাকে ট্রাকে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে পথনাটক করেন।
ড. ইনামুল হক অভিনীত উল্লেখযোগ্য মঞ্চনাটক হলো- দেওয়ান গাজীর কিসসা, নূরুল দীনের সারা জীবন, অচলায়তন, কোপেনিকের ক্যাপ্টেন, জনতার রঙ্গশালা, সরমা প্রভৃতি।
তাঁর অভিনীত টিভি নাটকগুলোর মধ্যে- মুখরা রমণী বশীকরণ, এইসব দিনরাত্রি, আয়োময়, এডহক, ভালোবাসার দেয়াল, অন্যতম।
ড. ইনামুল হক ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘নাগরিক নাট্যাঙ্গন’ । এই দল থেকে অনেক ভালো ভালো নাটক মঞ্চায়িত হয়েছে। ২০০০ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘নাগরিক নাট্যাঙ্গন ইন্সটিটিউট অব ড্রামা’ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান। এর অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
তিনি টেলিভিশনের জন্য ৫০টিরও অধিক নাটক লিখেছেন। তার লেখা টিভি নাটকের মধ্যে- অনেক দিনের একদিন, সেইসব দিনগুলি, বাংলা আমার বাংলা, মালা একশত মালঞ্চের, গৃহবাসী, মহাকালের ঘোড়সওয়ার, কাঙখিত বলয়, কিছুতো বলুন, নির্জন সৈকতে, কে বা আপন কে বা পর, প্রতিধ্বনি প্রতিদিন, উল্লেখযোগ্য।
ড. ইনামুল হক লেখা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- নির্জন সৈকতে, গৃহবাসী, মুক্তিযুদ্ধ নাটকসমগ্র, স্ট্রিন্ডবার্গ এর দু’টো নাটক, মহাকালের ঘোর সওয়ার, বাংলা আমার বাংলা প্রভৃতি।
ড. ইনামুল হক বেশকয়েকটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। তাঁর অভিনীত ছবিসমূহের মধ্যে- এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী, হুলিয়া, আধিয়ার, রূপকথার গল্প, প্রিয়তমেষু, আমার বন্ধু রাশেদ, বৃহন্নলা, অন্যতম উল্লেখযোগ্য।
ড. ইনামুল হক তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন বহু পুরস্কার ও সম্মাননা। যারমধ্যে আছে- একুশে পদক (২০১২), টেলিভিশন রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ পুরস্কার-আজীবন সম্মাননা (২০১২), স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১৭)।
ড. ইনামুল হক বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, বরেণ্য নাট্যজন লাকী ইনাম এর সাথে। এই দম্পতির দুই মেয়ে, হৃদি হক আর প্রৈতি হক দু’জনই নাটক ও অভিনয়ের সাথে জড়িত ।