English

21 C
Dhaka
বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ২৬, ২০২৪
- Advertisement -

দেশবরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞ আজাদ রহমান-এর মৃত্যুবার্ষিকী আজ

- Advertisements -

এ কে আজাদ: আজাদ রহমান। সুরকার-সঙ্গীত পরিচালক-কণ্ঠশিল্পী ও চিত্রপরিচালক। বাংলাদেশের সঙ্গীতের ভান্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে যাঁদের হাত ধরে, তিনি তাদেরই একজন। বাংলাদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অন্যতম প্রাণপুরুষ, একজন উচুমানের সঙ্গীত বিশারদ। যিনি বাংলা গানের প্রতিটি শাখায় রেখে গেছেন, আজন্ম লালিত ধ্রুপদী ছোঁয়া।

চলচ্চিত্রের গানেও তিনি অসাধারণ বৈচিত্র্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। বহুমাত্রিক এবং ভিন্নধর্মী সুমধুর সুরের কারণে তাঁর অনেক গানই হয়েছে জনপ্রিয়, পেয়েছে কালজয়ীর সম্মান ।

দেশবরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞ আজাদ রহমান-এর মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০২০ সালের ১৬ মে, ঢাকার একটি হাসপাতালে,৭৬ বছর বয়সে, মৃত্যুবরণ করেন। বরেণ্য এই সঙ্গীতশিল্পীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই । তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।

আজাদ রহমান ১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারি, ভারতের বর্ধমান জেলায়, জন্মগ্রহণ করেন। ভারতের রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, খেয়ালে অনার্স সম্পন্ন করেন তিনি। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীনই তিনি ফোক গান, কীর্তন, ধ্রুপদী সঙ্গীত, খেয়াল, টপ্পা গান, ঠুমড়ি, রবীন্দ্র সঙ্গীত, অতুল প্রসাদের গান, দিজেন্দ্র গীতি, রজনী কান্তের গান চর্চা করেন। সেই সময়েই একজন ক্রীশ্চান পুরোহিতের কাছ থেকে পিয়ানো বাজানো শেখেন তিনি।

আজাদ রহমান চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা শুরু করেন ১৯৬৭ সালে, কলকাতার ‘মিস প্রিয়ংবদা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। সেই চলচ্চিত্রে তাঁর সুরে কণ্ঠ দেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখার্জি ও প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলাদেশের তাঁর সুরারোপিত প্রথম চলচ্চিত্র বাবুল চৌধুরী পরিচালিত ‘আগন্তুক’, মুক্তিপায় ১৯৬৯ সালে । আজাদ রহমান আরো যেসব চলচ্চিত্রের সুর ও সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য- রাতের পর দিন, প্রিয়তমা, মাসুদ রানা, বাঁদী থেকে বেগম, এপার ওপার, মাস্তান, আগুন, দস্যু বনহুর, গোপন কথা, মায়ার বাঁধন, অনন্ত প্রেম, যাদুর বাঁশি, হাবা হাসমত, মতিমহল, আয়না, কুয়াশা, ডুমুরের ফুল, দি ফাদার, নবাব, নতুন বউ, আমার সংসার, পাগলা রাজা, তুফান, প্রিয়তমা, নওজোয়ান, গুনাহগার, দিলদার আলী, নবাবজাদী, লাভ ইন সিঙ্গাপুর, খোকন সোনা, মৌ চোর, টক্কর, রাজবন্দী, রাজবাড়ি, চাঁদাবাজ, দেশপ্রেমিক, প্রভৃতি।

আজাদ রহমান একটি চলচ্চিত্র পরিচালনাও করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে নির্মিত ‘গোপন কথা’ নামের এই চলচ্চিত্রটি মুক্তিপায় ১৯৭৬ সালে।

আজাদ রহমান সুরারোপিত কিছু কালজয়ী জনপ্রিয় গান-
‘ভালবাসার মুল্য কত’, ‘ডোরা কাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়’, ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মা গো’, ‘মন রেখেছি আমি তার মনেরও আঙ্গিনায়’, ‘এক বুক জ্বালা নিয়ে বন্ধু তুমি কেন একা বয়ে বেড়াও’, ‘মাগো তোর কান্না আমি সইতে পারি না, দোহাই মা আমার লাইগা আর কান্দিস না’, ‘মনেরই রঙে রাঙাবো, বনেরই ঘুম ভাঙাবো’, ‘তুমি হলে তুমি, দূর এল কাছে’, ‘বন্ধু ওগো কী করে ভাবলে’, ‘ও চোখে চোখ পড়েছে যখনি’, ‘যাদু বিনা পাখি’, ‘ঐ মধু চাঁদ আর এই জোসনা’, ‘ও পদ্মা নদী একটু যদি সহায় হতো’, ‘আমি কপোলে পড়েছি স্বামীর সোহাগের চন্দন’, ‘বনে বনে যত ফুল আছে’, ‘তোমার নামে শপথ নিলাম, তোমায় আমি কথা দিলাম’, ‘দুটি মন যখন কাছে এলো’, ‘কচি ডাবের পানি এক আনা দু আনা’, ‘হীরার চেয়ে দামি, ফুলের চেয়ে নামী আমার নুরজাহান’, ‘মাগো তোর চরণ তলে বেহেস্ত আমার’, ‘বন্দী পাখির মতো মনটা কেঁদে মরে’, ‘আমি চলতে গেলে পা চলে না, বসতে চাইলে মন বসে না’, ‘সোনা দোলে যাদু দোলে, দোলে খোকন সোনা মায়ের কোলে’, ‘দুটি পাখি একটি নীড় একটি নদীর দুটি তীর’, ‘চঞ্চল দু’নয়নে বলোনা কি খুঁজচ্ছ’, ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

আজাদ রহমান কয়েকটি চলচ্চিত্রে কন্ঠও দিয়েছেন। তাঁর নিজের কন্ঠে গাওয়া সেসব গানও খুব জনপ্রিয় হয়েছে, যা এখনও শ্রোতাদের হৃদয়ে অমলিন হয়ে আছে। তাঁর স্বকণ্ঠে গাওয়া, দস্যুবনহুর (১৯৭৬) ছবিতে- ‘ডোরাকাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়, ‘এপার ওপার’ (১৯৭৫) ছবিতে- ‘ভালবাসার মূল্য কত, আমি কিছু জানিনা’, ‘ডুমুরের ফুল’ (১৯৭৮) ছবিতে- ‘করো মনে ভক্তি মায়ের, হাতে থাকতে দিন’, ‘গুনাহগার’ (১৯৭৮) ছবিতে- ‘লোকে আমায় কয় গুনাহগার’, ‘চাঁদাবাজ’ (১৯৯৩) ছবিতে- ‘মুক্তিযোদ্ধা কোথায় তুমি, দেখো এসে জন্মভূমি’ । তিনি শ্রেষ্ঠ কণ্ঠশিল্পী হিসেবেও ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’ পেয়েছেন।

চলচ্চিত্রের বাইরে বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের জন্যও অনেক আধুনিক ও দেশাত্মবোধক গানে সুর করেছেন আজাদ রহমান। সেসব গানগুলো হয়েছে জনপ্রিয় ।
আজাদ রহমান-এর পরিচালনায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে ছোটদের সঙ্গীত শিক্ষার অনুষ্ঠান বেশ কয়েক বছর প্রচারিত হয়েছে।

তিনি তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’সহ পেয়েছেন নানা পুরস্কার ও সম্মাননা, যারমধ্যে উল্লেখযোগ্য- ‘যাদুর বাঁশি’ (১৯৭৭) ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ সুরকার হিসেবে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’, ‘চাঁদাবাজ’ (১৯৯৩) ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’ এবং চাঁদাবাজ ছবিতে শ্রেষ্ঠ পুরুষ কণ্ঠশিল্পী’র ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’ অর্জন করেন তিনি।

ব্যক্তিজীবনে আজাদ রহমান ১৯৭৩ সালে, জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী সেলিনা আজাদ-এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের তিন কন্যাসন্তান রয়েছে। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক কাজী হায়াৎ, আজাদ রহমান-এর ভগ্নিপতি ।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন আজাদ রহমান। ছিলেন সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ। তিনি বেশ কিছু দিন নজরুল ইনস্টিটিউটেও শিক্ষকতা করেছেন। দেশের এই বরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞকে নিয়ে ‘বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ’ একটি ডকুমেন্টেশন তৈরি করে ২০১৭ সালে । বাংলা একাডেমি থেকে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা সংগীত বিষয়ক বই ‘বাংলা খেয়াল’।

সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক, গীতিকার, গায়ক, চলচ্চিত্র পরিচালক, সংগীতচর্চার শিক্ষক আজাদ রহমান।
তিনি চলচ্চিত্রের গান, ফোক, খেয়াল, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, রাগ, ঠুমরী, টপ্পা, আধুনিক সব ধরণের গানেই ছিলেন সমান পারদর্শী। গীটার, কীবোর্ড, পিয়ানো, বেহালা’সহ সব ধরণের বাদ্যযন্ত্রও ছিল তাঁর আয়ত্তের মধ্যে।

প্রথম বাংলা খেয়াল-এর স্রষ্টা তিনি। বাংলাদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অন্যতম প্রাণপুরুষ, একজন উচুমানের সঙ্গীত বিশারদ আজাদ রহমান। যিনি বাংলা গানের প্রতিটি শাখায় রেখে গেছেন, আজন্ম লালিত ধ্রুপদী ছোঁয়া।
চলচ্চিত্রের গানেও তিনি অসাধারণ বৈচিত্র্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। বহুমাত্রিক এবং ভিন্নধর্মী সুমধুর সুরের কারণে তাঁর অনেক গানই হয়েছে জনপ্রিয়, পেয়েছে কালজয়ীর সম্মান । যা এখনও দর্শক-শ্রোতাদেরকে বিমোহিত করে, উদ্বেলিত করে।
বাংলাদেশের সঙ্গীতের ভান্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে যার হাত ধরে, সেই মহান সঙ্গীতজ্ঞ আজাদ রহমান তাঁর সৃজনশীল কর্মের মাধ্যমে বেঁচে থাকবেন- অনন্তকাল ধরে।

Notify of
guest
0 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরাতন
সবচেয়ে নতুন Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Advertisements
সর্বশেষ
- Advertisements -
এ বিভাগে আরো দেখুন