দেশবরেণ্য কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০২১ সালের ৩ জানুয়ারি, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। প্রয়াণ দিবসে এই গুণীজনের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত প্রার্থণা করি।
বাংলাদেশের সাহিত্যের সৃজনশীল, কীর্তিমান লেখিকা রাবেয়া খাতুন ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর, বিক্রমপুরে তাঁর মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার ষোলঘর গ্রামে৷ তাঁর বাবা মৌলভী মোহাম্মদ মুল্লুক চাঁদ এবং মা হামিদা খাতুন। তিনি আরমানিটোলা বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা (বর্তমানে মাধ্যমিক) পাস করেন। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে হওয়ায় বিদ্যালয়ের গন্ডির পর, তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ আর এগোয়নি ।
রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্মেও নারীর অবরুদ্ধতার অবসান ঘটিয়ে মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন রাবেয়া খাতুন। সমাজ সংস্কারের লক্ষ্যে অল্প বয়সেই লেখনীর সূচনা ঘটান, এক সময় সাহিত্যাঙ্গনে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন নিজের অবস্থান।
কথাসাহিত্যিক হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও কর্মজীবনে তিনি এক সময় শিক্ষকতা করেছেন। একই সাথে লেখালেখির পাশাপাশি ‘সিনেমা’ ও ‘অঙ্গনা’ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন।
রাবেয়া খাতুনের প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘মধুমতি’, যা প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। এর আগে তিনি ‘নিরাশ্রয়া’, ‘বিদায়’ ও ‘অশোক-রেবা’ নামে আরো তিনটি উপন্যাস লিখেছিলেন যা প্রকাশিত হয়নি।
উপন্যাস, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, কিশোর উপন্যাস এবং স্মৃতিকথা মিলিয়ে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় শতাধিক। তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে-
মধুমতী, সাহেব বাজার, অনন্ত অন্বেষা, রাজারবাগ শালিমারবাগ, মন এক শ্বেতকপোতী, ফেরারী সূর্য, অনেকজনের একজন, জীবনের আর এক নাম, দিবস রজনী, সেই এক বসন্তে, মোহর আলী, নীল নিশীথ, বায়ান্ন গলির একগলি, পাখি সব করে রব, নয়না লেকে রূপবান দুপুর, মিড সামারে, ই ভরা বাদর মাহ ভাদর, সে এবং যাবতীয়, হানিফের ঘোড়া, হিরণ দাহ, মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস সমগ্র, এই বিরল কাল, হোটেল গ্রীন বাটন, চাঁদের ফোটা, নির্বাচিত প্রেমের উপন্যাস, বাগানের নাম মালনিছড়া, প্রিয় গুলসানা, বসন্ত ভিলা, ছায়া রমণী, সৌন্দর্য সংবাদ, হৃদয়ের কাছের বিষয়, ঘাতক রাত্রি, শ্রেষ্ঠ উপন্যাস, মালিনীর দুপুর, রঙিন কাচের জানালা, মেঘের পর মেঘ, যা কিছু অপ্রত্যাশিত, দূরে বৃষ্টি, সাকিন ও মায়াতরু, রমনা পার্কের পাঁচবন্ধু, শুধু তোমার জন্য, ঠিকানা বি এইচ টাওয়ার, কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি, প্রথম বধ্যভূমি, কমলিকা, দশটি উপন্যাস, শঙ্খ সকাল প্রকৃতি, যা হয়না, আকাশে এখনো অনেক রাত, উপন্যাস সমগ্র, স্বনিবার্চিত উপন্যাস, জাগতিক, স্বপ্নে সংক্রামিত, ও কে ছিল, মহা প্রলয়ের পর, নির্বাচিত উপন্যাস, শহরের শেষ বাড়ি, নষ্ট জ্যোস্নার আলো, মাইগো, সমুদ্রবণ ও প্রণয় পুরুষ, এই দাহ এবং রাইমা ইত্যাদি।
রাবেয়া খাতুনের গল্প ও উপন্যাস নিয়ে বহু টিভিনাটক ও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তাঁর কাহিনীতে যেসব নাটক নির্মিত হয়েছে তারমধ্যে আছে- পাঁচটা পোড়া সিগারেট, অরণ্য মঞ্জুরি, অমিত্রাক্ষর, অন্য একুশ, অঙ্গনে আগন্তুক, আক্রান্ত একজন, আলাপী, এবং তারপর, একটি মুক্তা, একজন সুস্থ মানুষের চিঠি, একটু বাড়িয়ে বলা, কদম ফুল মেয়ে, টংঘর, একাত্তরের নয় মাস, কাল্পনিক চরিত্র, কুয়াশার ভোর, যে ভুলে যায়, সূর্য ওঠার আগে, সেই এক সন্ধ্যা, সেতু, স্থায়ী ঠিকানা, শহরের শেষ বাড়ি, শিউলি কথা, শ্রাবন্তী ও পল্লবের গল্প, হৃদয়ের কাছের বিষয়, ডেটলাইন মালিনীছড়া, মোহর আলী, অন্যতম।
রাবেয়া খাতুনের উপন্যাস নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রসমূহ- সান অফ পাকিস্তান (শিশুতোষ চলচ্চিত্র), কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি, মেঘের পরে মেঘ, ধ্রুবতারা, মধুমতি।
তাঁর কাহিনীতে নির্মিত চলচ্চিত্রসমূহ দর্শকমহলে প্রসংশিত ও সমাদৃত হয়েছে। ‘সান অফ পাকিস্তান’ সেই সময়ে পুরস্কৃত হয়েছিল। তাঁর জনপ্রিয় উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘মেঘের পরে মেঘ’ যেমন সর্বমহলে প্রসংশিত ও সমাদৃত হয়েছে, তেমনই পুরস্কৃত হয়েছেন তিনি।
রাবেয়া খাতুন দীর্ঘদিন যাবৎ শিল্প, সাহিত্য, চলচ্চিত্রসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে জড়িত থেকেছেন। বাংলা একাডেমি কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের গঠনতন্ত্রের পরিচালনা পরিষদের সদস্য এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জুরিবোর্ডের বিচারক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তিনি শিশু একাডেমি, বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ, ঢাকা লেডিস ক্লাব, বিজনেস ও প্রফেশনাল উইমেনস ক্লাব, বাংলাদেশ লেখক শিবির, বাংলাদেশ কথাশিল্পী সংসদ ও মহিলিা সমিতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন।
রাবেয়া খাতুন তাঁর দীর্ঘ কর্মময় জীবনের স্বীকৃতিস্বরুপ পেয়েছেন জাতীয় পর্যায়সহ বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা।
সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছেন- একুশে পদক (১৯৯৩), স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১৭), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭৩), নাসিরুদ্দিন স্বর্ণ পদক (১৯৯৫), হুমায়ূন স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৯), কমর মুশতারী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৪), বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৯৪), শের-ই-বাংলা স্বর্ণ পদক (১৯৯৬), ঋষিজ সাহিত্য পদক (১৯৯৮), লায়লা সামাদ পুরস্কার (১৯৯৯) ও অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৯)।
ছোট গল্পের জন্য পেয়েছেন- নাট্যসভা পুরস্কার (১৯৯৮)। সায়েন্স ফিকশন ও কিশোর উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন- শাপলা দোয়েল পুরস্কার (১৯৯৬), অতীশ দীপঙ্কর পুরস্কার (১৯৯৮), ইউরো শিশু সাহিত্য পুরস্কার (২০০৩)।
এছাড়াও- টেনাশিনাস পুরস্কার (১৯৯৭), বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাংলাদেশ কালচারাল রিপোর্টাস এসোসিয়েশন মিলেনিয়াম অ্যাওয়ার্ড (২০০০), টেলিভিশন রিপোর্টাস অ্যাওয়ার্ড (২০০০)’সহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন তিনি।
ব্যক্তিগত জীবনে রাবেয়া খাতুন ১৯৫২ সালের ২৩ জুলাই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, এদেশের প্রথম চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকা ‘সিনেমা’র প্রকাশক-সম্পাদক ও এদেশের প্রথম শিশুতোষচলচ্চিত্রের পরিচালক এটিএম ফজলুল হক-এর সাথে। তাদের চার সন্তান রয়েছে- বড় ছেলে ফরিদুর রেজা সাগর, একজন খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। মেয়ে কেকা ফেরদৌসী একজন রন্ধন বিশেষজ্ঞ। আরেক ছেলে ফরহাদুর রেজা প্রবাল, সে একজন ইঞ্জিনিয়ার এবং টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপক। ছোট মেয়ে ফারহানা মাহমুদ কাকলী।
বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের সামগ্রিক অগ্রযাত্রায় রাবেয়া খাতুনের অবদান অতিব তাৎপর্যপূর্ণ। সাহিত্যকর্ম বিবেচনায় তিনি একদিকে গ্রামভিত্তিক মধ্যবিত্ত সমাজের রূপান্তরের রূপকার এবং অন্যদিকে নাগরিক মধ্যবিত্তের বিকাশ ও বিবর্তনের দ্রষ্টা। সর্বক্ষেত্রেই রয়েছে তাঁর নিজস্ব জীবনবোধ ও অন্তর্দৃষ্টিমূলক প্রতিভার সমন্বয়।
ছোটগল্প, ভ্রমণসাহিত্য, স্মৃতিকথামূলক রচনা, শিশুসাহিত্যে তাঁর স্বকীয়তা বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ও গল্প রচনায় তাঁর অবদান বাংলা সাহিত্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
দেশবরেণ্য খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন। বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনের একজন প্রথিতযশা ব্যক্তিত্ব। ছিলেন সরল মনের, বিশাল হৃদয়ের একজন ভালো মানুষ। অনন্তলোকে তিনি ভালো থাকুন- এই প্রার্থণা করি।