আজাদ আবুল কাশেম: দেশবরেণ্য ও জননন্দিত কন্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী’র তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০১৯ সালের ৭ মে, সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর। বরেণ্য এই সঙ্গীতশিল্পীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই ।
কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী ১৯৫৩ সালের ১৯ নভেম্বর, হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং থানার নন্দী পাড়ায়, এক সম্ভ্রান্ত কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সুধাংশু নন্দী ছিলেন একজন চিকিৎসক ও সঙ্গীতপ্রেমী। তাঁর মা পুতুল রানী গান গাইতেন। সঙ্গীতে হাতেখড়ি মায়ের কাছেই। তবে ভাই-বোনদের সঙ্গে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নেন, ওস্তাদ বাবর আলী খানের কাছে। হবিগঞ্জ শহরে সুবীর নন্দীদের একটি বাড়ি ছিল, সেখানে থেকে পড়ালেখা করেছেন ‘হবিগঞ্জ গভঃ হাইস্কুলে’। তারপর হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজে।
তৃতীয় শ্রেণীতে থাকা অবস্থায়ই তিনি গান করতেন। ১৯৬৭ সালে, প্রথম সিলেট বেতারে গান করেন সুবীর নন্দী। সেই সময়ে তাঁর গানের ওস্তাদ ছিলেন গুরু বাবর আলী খান। লোকগান শিখাতেন বিদিত লাল দাশ।
সুবীর নন্দী ঢাকা রেডিওতে প্রথম গান গাওয়া শুরু করেন ১৯৭০ সালে। প্রথম গান ছিল ‘যদি কেউ ধূপ জ্বেলে দেয়’, গীতিকার মোহাম্মদ মুজাক্কের এবং সুরকার ছিলেন ওস্তাদ মীর কাসেম। পরবর্তিতে টেলিভিশনেও গান গাওয়া শুরু করেন তিনি এবং বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
১৯৮১ সালে, তাঁর প্রথম একক অ্যালবাম (ক্যাসেট) ‘সুবীর নন্দীর গান’ ডিসকো রেকর্ডিংয়ের ব্যানারে বাজারে আসে। এরপরে আরো প্রকাশিত হয়- ‘প্রেম বলে কিছু নেই’, ‘দুখের পর সুখ’, ‘ভালোবাসা কখনো মরে না’, ‘সুরের ভুবনে’, ‘গানের সুরে আমায় পাবে’ এবং ‘প্রণামাঞ্জলী’ নামে একটি ভক্তিমূলক গানের অ্যালবাম ।
সুবীর নন্দী চলচ্চিত্রে প্রথম কন্ঠ দেন ১৯৭৬ সালে, আব্দুস সামাদ পরিচালিত ‘সূর্যগ্রহণ’ ছবিতে। তিনি আরো যেসব চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য- মা, অশিক্ষিত, দিন যায় কথা থাকে, বন্ধু, বদলা, আমির ফকির, মাটির মানুষ, অংশিদার, প্রতিজ্ঞা, রাজার রাজা, দেবদাস, রাম রহিম জন, মহানায়ক, চন্দ্রনাথ, শুভরাত্রি, শুভদা, কাজললতা, লাল গোলাপ, পরিণীতা, রাজলক্ষী শ্রীকান্ত, আলী বাবা ৪০ চোর, সুদ-আসল, রাঙাভাবী, বিরাজ বৌ, স্বাক্ষী, পদ্মা মেঘনা যমুনা, স্নেহ, বিক্ষোভ, মায়ের অধিকার, আনন্দ অশ্রু, শ্রাবণ মেঘের দিন, চন্দ্রকথা, মেঘের পরে মেঘ, শ্যামল ছায়া, হাজার বছর ধরে, শত্রু শত্রু খেলা, চন্দ্রগ্রহণ, আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা, অবুঝ বউ, দুই পুরুষ, মাটির পিঞ্জিরা, মহুয়া সুন্দরী, প্রভৃতি।
সুবীর নন্দীর গাওয়া কালজয়ী জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে আছে- ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়’, ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’, ‘আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি’, ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে’, জীবনের গল্প এতো ছোট নয়’, ঐ রাত ডাকে ঐ চাঁদ ডাকে তুমি কোথায়’, ‘মনরে সুখ পাখি তোর হইলো না আপন’, ‘তুমি এমনই জাল পেতেছ সংসারে’, ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু বলে গণ্য হলাম’, ‘কতো যে তোমাকে বেসেছি ভালো’, আহা কাঙ্খে কলসী, গাঁয়ের রূপসী’, ‘এই দুনিয়ার রাস্তাঘাটে কত মানুষ দিনে রাতে’, ‘কেন ভালোবাসা হারিয়ে যায়’, ‘মন দিলাম প্রাণ দিলাম আর কি দিবোরে’, ‘সুরের ভূবনে আমি আজো পথচারী’, ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’, ‘ও আমার উড়াল পঙ্খীরে’, ‘পাহাড়ের কান্না দেখে তোমরা তাকে ঝর্ণা বলো’, ‘অবুঝ নদীর দুই কিনার’, ‘আশা ছিল মনে মনে’, বধূ তোমার আমার এই যে পীরিতি’, ‘মাস্টারসাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই’, ‘বন্ধু তোর বরাত নিয়া আমি যাবো’, তোমারই পরশে জীবন আমার ওগো ধন্য হলো’, ‘নেশার লাটিম ঝিম ধরেছে’, ‘চাঁদের কলঙ্ক আছে’, ‘কেঁদো না তুমি কেঁদো না’, ‘পাখিরে তুই দূরে থাকলে কিছুই আমার ভালো লাগে না’ ইত্যাদি।
সুবীর নন্দী তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পাঁচবার পেয়েছেন, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ১৯৮৪ সালে, শ্রেষ্ঠ পুরুষ কন্ঠশিল্পী ‘মহানায়ক’ ছবিতে, ১৯৮৬ সালে শ্রেষ্ঠ পুরুষ কন্ঠশিল্পী ‘শুভদা’ ছবিতে, ১৯৯৯ সালে শ্রেষ্ঠ পুরুষ কন্ঠশিল্পী ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ছবিতে, ২০০৪ সালে শ্রেষ্ঠ পুরুষ কন্ঠশিল্পী ‘মেঘের পরে মেঘ’ ছবিতে, ২০১৫ সালে শ্রেষ্ঠ পুরুষ কন্ঠশিল্পী ‘মহুয়া সুন্দরী’ ছবিতে।
শিল্পকলায় অবদানের জন্য ২০১৯ সালে পেয়েছেন ‘একুশে পদক’। এছাড়াও বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ আরো পেয়েছেন নানাধরণের পদক, ক্রেস্ট ও সম্মাননা।
বাংলা গানের অতি জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী, গান গাওয়ার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ব্যাংকে চাকরি করেছেন।
সুবীর নন্দী বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে ইংল্যান্ড, সুইডেন, যুগোস্লাভিয়া, আমেরিকা, আরব আমিরাত, জাপান, নেপাল ও ভারত’সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংগীত পরিবেশন করেছেন।
আধুনিক ও চলচ্চিত্রের গানের প্রতিভাবান মেধাবী কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী। বাংলা সংগীত জগতের দেশবরেণ্য ও জনন্দিত সংগীতশিল্পী তিনি। বেতার-টেলিভিশন-চলচ্চিত্র সবখানেই তিনি সমান জনপ্রিয় । চলচ্চিত্রের বাইরেও বেতার-টেলিভিশনে অসংখ্য শ্রুতিমধুর ভালো গান গেয়ে বর্নীল করেছেন নিজের সঙ্গীত জীবন, কণ্ঠযাদুতে বিমোহিত করেছেন-রাঙিয়েছেন কোটি মানুষের মন। আধুনিক, দেশাত্মবোধক, ফোক সবধরনের গানেই তাঁর পারদর্শীতা-জনপ্রিয়তা বিস্তৃত ছিল ।
সুলোলীত-শ্রুতিমধুর কন্ঠের অধিকারী সুবীর নন্দী তাঁর কন্ঠযাদুতে বিমোহিত করেছেন সকল বাংলা ভাষা-ভাষী সংগীতপ্রিয় মানুষদের। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে বহু কালজয়ী জনপ্রিয় গানের কন্ঠশিল্পী তিনি। যাঁদের মেধায়, শ্রমে, ঘামে সমৃদ্ধ হয়েছে আমাদের গানের জগত, তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদোশের চলচ্চিত্রের গানের সফল সমৃদ্ধিতে যাদের অবদান অনিস্বীকার্য তাদের মধ্যে সুবীর নন্দী একজন। মিস্টি হাসি আর মৃদু ভাষী, নিপাট ভদ্রলোক হিসেবে তাঁর সুপরিচিতি ছিল সঙ্গীতাঙ্গনের মানুষদের কাছে । বাংলাদেশের সঙ্গীতজগতের সবচেয়ে উজ্জ্বল এই তারকাটি অনন্তলোকে চিরশান্তিতে থাকবেন- এই আমাদের প্রার্থণা।