এ কে আজাদ: আবদুল কাদের। অভিনেতা। বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটকের অন্যতম একজন সেরা কৌতুক অভিনেতা ছিলেন আবদুল কাদের। নিখুঁত অভিনয়ের মাধ্যমে টেলিভিশনের পর্দায় সবচেয়ে বেশি হাস্যরস ফুটিয়ে তোলায় পারদর্শি ছিলেন তিনি। দর্শকদের অতিপ্রিয় অভিনেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজ অভিনয় গুণে। বাংলাদেশের টেলিভিশনপর্দা হাসির বন্যায় ভাসিয়ে, নাটকে কৌতুক অভিনয়কে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি। যে কয়টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন, সেখানেও রুচিসম্মত কৌতুক অভিনেতা হিসেবে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। অসম্ভব জনপ্রিয় অভিনেতা ও আনন্দময় একজন মানুষ ছিলেন তিনি।
জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা আবদুল কাদের-এর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০২০ সালের ২৬ ডিসেম্বর, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর। প্রয়াত এই গুণী অভিনেতার স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই । তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
আব্দুল কাদের ১৯৫১ সালে, মুন্সীগঞ্জ জেলার টংগিবাড়ী উপজেলার সোনারং গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম আবদুল জলিল, মা আনোয়ারা খাতুন।
প্রথমে সোনারং হাইস্কুলে পড়ালেখা করে পরে বন্দর হাইস্কুল থেকে এস.এস.সি ও ঢাকা কলেজ থেকে এইচ.এস.সি পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে বি.এ অনার্স এবং এম.এ পাস করেন তিনি।
আব্দুল কাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন ১৯৭২-৭৪ পর্যন্ত পরপর তিন বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মহসিন হল ছাত্র সংসদের নাট্যসম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ডাকসু নাট্যচক্রের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯৭৩ সাল থেকে থিয়েটার নাট্যগোষ্ঠীর সদস্য এবং চার বছর যুগ্ম-সম্পাদক ও ছয় বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকায় আমেরিকান কলেজ থিয়েটার ট্রুপ কর্তৃক আয়োজিত অভিনয় কর্মশালায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। আবদুল কাদের বাংলাদেশ টেলিভিশনের নাট্যশিল্পী ও নাট্যকারদের সংগঠন ‘টেলিভিশন নাট্যশিল্পী ও নাট্যকার সংসদ’ টেনাশিনাস এর সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন কলেজে শিক্ষকতা দিয়ে। পরে বিটপী বিজ্ঞাপনী সংস্থায় এক্সিকিউটিভ হিসেবে চাকরি করেন, ১৯৭৯ সাল থেকে বহুজাতিক কোম্পানী ‘বাটা’তে উচ্চপদে কর্মরত ছিলেন আবদুল কাদের।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে তাঁর প্রথম নাটকে অভিনয় শুরু । তিনি ১৯৭২ সালে আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন মহসিন হল এর নাটক সেলিম আল দীন রচিত ও নাসিরউদ্দিন ইউসুফ নির্দেশিত ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’-এ সেরা অভিনেতা হিসেবে পুরস্কার লাভ করেছিলেন।
১৯৮২ সাল থেকে টেলিভিশন ও ১৯৮৩ সাল থেকে বেতারের নাটকে অভিনয় শুরু করেন। আবদুল কাদের থিয়েটারের হয়ে মঞ্চনাটকে প্রায় এক হাজারের মতো প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন। টেলিভিশনেও প্রায় এক হাজারেরও বেশি নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি।
আবদুল কাদের অভিনীত উল্লেখযোগ্য মঞ্চনাটকসমূহ-
পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, এখনও ক্রীতদাস, তোমরাই, স্পর্ধা, দুই বোন, মেরাজ ফকিরের মা প্রভৃতি।
তাঁর টেলিভিশন নাটকের মধ্যে- হরিণ চিতা চিল, আবদুল, কোথাও কেউ নেই, মাটির কোলে, নক্ষত্রের রাত, শীর্ষবিন্দু, সবুজ সাথী, তিন টেক্কা, যুবরাজ, আগুন লাগা সন্ধ্যা, এই সেই কণ্ঠস্বর, আমার দেশের লাগি, প্যাকেজ সংবাদ, সবুজ ছায়া, কার ছায়া ছিল, দীঘল গায়ের কন্যা, কুসুম কুসুম ভালোবাসা, নীতু তোমাকে ভালোবাসি, আমাদের ছোট নদী, ভালমন্দ মানুষেরা, দূরের আকাশ, ফুটানী বাবুরা, হারানো সুর, দুলা ভাই, অজ্ঞান পার্টি, লোভ, মোবারকের ঈদ, বহুরূপী, এই মেকাপ, ঢুলী বাড়ী, সাত গোয়েন্দা, একজনমে, জল পড়ে পাতা নড়ে, খান বাহাদুরের তিন ছেলে, ইন্টারনেটের বউ, ঈদ মোবারক, সিটিজেন, হতাই, ফাঁপর, চারবিবি, সুন্দরপুর কতদূর, ভালবাসার ডাক্তার, চোরাগলি, বয়রা পরিবার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বিটিভিতে প্রচারিত হুমায়ূন আহমেদ রচিত জনপ্রিয় বিখ্যাত নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’ ধারাবাহিক নাটকে ‘বদি’ চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করে কিংবদন্তী হয়ে আছেন অভিনেতা আবদুল কাদের ।
হানিফ সংকেত চরিত-পরিচালিত অতি জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে নিয়মিত অভিনয় করেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে ছিলেন তিনি। বেশ কয়েকটি বিজ্ঞাপনচিত্রেও অভিনয় করেছেন।
অভিনেতা আবদুল কাদের কয়েকটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্র- সারেং বউ, দাবী, রং নাম্বার, ভালোবাসা জিন্দাবাদ ও দুই বিয়াইয়ের গল্প।
আবদুল কাদের দীর্ঘ অভিনয় জীবনের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন বহু পুরস্কার ও সম্মাননা। যারমধ্যে- টেনাশিনাস পদক, মহানগরী সাংস্কৃতিক ফোরাম পদক, অগ্রগামী সাংস্কৃতিকগোষ্ঠী পদক, যাদুকর পি.সি. সরকার পদক, টেলিভিশন দর্শক ফোরাম অ্যাওয়ার্ড, মহানগরী সংস্কৃতিগোষ্ঠী পুরস্কার অন্যতম।
ব্যক্তিগতজীবনে আবদুল কাদের, অভিনেত্রী খাইরুননেছা কাদেরকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।
বাংলাদেশের মঞ্চ ও টেলিভিশনের অতি পরিচিত মুখ আবদুল কাদের। একজন প্রতিভাবান ও স্বার্থক অভিনয়শিল্পী, নানা ধরণের চরিত্রে অভিনয় করে গেছেন সফলতার সাথে। বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনের লোকদের কাছে, অত্যান্ত ভদ্র ও ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। শিল্প-সংস্কৃতিঅঙ্গনের সকলের পছন্দের মানুষ, অভিনেতা আবদুল কাদের অনন্তলোকে ভালো থাকুন- এই প্রার্থণা করি।