আজাদ আবুল কাশেম: চিত্রপরিচালক তারেক মাসুদ চলে যাওয়ার ১১ বছর আজ। তিনি ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট, মানিকগঞ্জের ঘিওরে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৫ বছর। প্রয়াত তারেক মাসুদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
তারেক মাসুদ ১৯৫৬ সালের ৬ ডিসেম্বর, ফরিদপুর জেলার, ভাঙ্গা উপজেলার নূরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম মশিউর রহমান মাসুদ ও মায়ের নাম নুরুণ নাহার মাসুদ । ভাঙ্গা ঈদগা মাদ্রাসায় প্রথমে পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। পরবর্তীতে ঢাকার লালবাগের একটি মাদ্রাসা থেকে মৌলানা পাস করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিনি ফরিদপুরের ভাঙ্গা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রাইভেট পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ম্যাট্রিক পাস করেন। আইএ পাস করেন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে। এরপর প্রথমে নটর ডেম কলেজে ভর্তি হলেও, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই লেখক শিবির, বামরাজনৈতিক আন্দোলন এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থেকেছেন তারেক মাসুদ।
১৯৮২ সালের শেষের দিকে ‘বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ’ থেকে ‘ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স’ শেষ করে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। তাঁর প্রথম নির্মিত ‘আদম সুরত’ নামে প্রামাণ্যচিত্রটি ছিল বাংলাদেশের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের জীবনের উপর। সাত বছরব্যাপি এটির নির্মাণ কাজ চলে। এরপর আরো বেশ কিছু ডকুমেন্টারি, অ্যানিমেশন এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তিনি।
তারেক মাসুদ ১৯৯৬ সালে নির্মাণ করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় একটি ভ্রাম্যমাণ গানের দলকে নিয়ে ‘মুক্তির গান’। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে মার্কিন নির্মাতা লিয়ার লেভিনের ক্যামেরায় ধারণ করা ফুটেজের সাথে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংরক্ষণাগার থেকে নেয়া ফুটেজ জুড়ে দিয়ে এই ছবিটি নির্মাণ করা হয়।
তারেক মাসুদ আরো নির্মাণ করেন- মুক্তির কথা (ভিডিও চলচ্চিত্র), মাটির ময়না, অন্তর্যাত্রা, নরসুন্দর (স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র), রানওয়ে, কাগজের ফুল(এই ছবি নির্মাণ করা অবস্থায় তিনি মারা যান)। স্বল্পদৈর্ঘ্য, পূর্ণদৈর্ঘ্য, প্রামাণ্যচিত্র ও অ্যানিমেশন সবমিলিয়ে তিনি মোট ১৬টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন।
চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’সহ পেয়েছেন আন্তর্জাতিক পুরস্কার। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়েছে। প্রসংশিত হয়েছে এবং পুরস্কৃত হয়েছে তাঁর নির্মিতি চলচ্চিত্র।
ব্যক্তিগত জীবনে তারেক মাসুদ, একজন মার্কিন নাগরিক ক্যাথরিন-এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন । এই দম্পতির বিংহাম পুত্রা মাসুদ নিশাদ নামে এক ছেলে রয়েছে।
বাংলাদেশের বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সংগঠন ‘শর্ট ফিল্ম ফোরাম’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তারেক মাসুদ। ১৯৮৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসবের, কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। এছাড়া কয়েকটি সাময়িকী ও পত্রিকায় চলচ্চিত্র বিষয়ে লেখালেখিও করতেন। ক্যাথরিন এবং তারেক মাসুদ মিলে ‘অডিওভিশন’ নামে ঢাকায় একটি চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন ।
তারেক মাসুদ চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। শিল্প-সংস্কৃতি ও দর্শনচর্চায় নিজেকে যুক্ত রেখেছেন সবসময় । বাংলা চলচ্চিত্রে নতুন ধারার সূচনা করেছিলেন তিনি। তরুণ চিত্রনির্মাতাদের কাছে ছিলেন স্বপ্নপুরুষ । প্রথম বাংলাদেশী চলচ্চিত্র হিসেবে অস্কারে স্থান পেয়েছিল তাঁর নির্মিত ‘মাটির ময়না’ ছবিটি।