English

26 C
Dhaka
রবিবার, নভেম্বর ১৭, ২০২৪
- Advertisement -

চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার মহিরূহ ব্যক্তিত্ব: এটিএম আব্দুল হাই শ্রদ্ধায় স্মরণ করি তাঁকে

- Advertisements -

আজাদ আবুল কাশেম: এটিএম আব্দুল হাই। প্রতিথযশা সাংবাদিক। আমাদের দেশের চলচ্চিত্র সাংবাদিকতায় স্টুডিও প্রতিবেদনের পথিকৃৎ তিনি।

এক সময়ে চলচ্চিত্র সাংবাদিকতায় তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল রীতিমতো ঈর্ষনীয় পর্যায়ে। একসময় চলচ্চিত্র সাংবাদিক তথা চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সকল কলা-কূশলী অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কাছে তাঁর সন্মান ছিল বেশ উঁচুস্থানে। তখনকার সময়ে ‘চিত্রালী’র পাঠক-পাঠিকাদের সুপ্রিয় উত্তরদা (এটিএম আব্দুল হাই)’র প্রয়াণ দিবস আজ। তিনি ২০০১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। প্রয়াত এই সাদা মনের গুণি মানুষটির স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।

এটিএম আব্দুল হাই ১৯৩৩ সালের ৩ ডিসেম্বর, কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব বাজারে, জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মহিউদ্দিন আহমেদ, ভৈরব বাজারের বিশিষ্ট আলেম হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন, মা আমেনা বেগম। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে, তিনি ছিলেন সবার বড়।

তিনি লেখাপড়া করেছেন- ভৈরব কে বি স্কুলে, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ এবং রংপুর কারমাইকেল কলেজে। ছাত্র হিসেবে ছিলেন যেমন মেধাবী, খেলাধুলায়ও ছিলেন তেমনি সেরা। ফুটবল-ব্যাডমিন্টন খেলে বহু পুরষ্কার জিতেছেন তিনি। শৈশব থেকে সংস্কৃতিমনা এটিএম আব্দুল হাই গান-বাজনা ও অভিনয়ের প্রতি ছিল তাঁর দারুন ঝোঁক। কলেজজীবনে গান গেয়ে, নাটকে অভিনয় করে বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন।

চলচ্চিত্র তথা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগী এটিএম আব্দুল হাই এক সময় চলচ্চিত্র সাংবাদিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। সেই সময়ে আমাদের দেশে শিল্প- সাংস্কৃতিক অঙ্গণের খবরাখবরের অন্যতম কাগজ ছিল সাপ্তাহিক ‘চিত্রালী’। বহুল প্রচারিত, খুবই জনপ্রিয় এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব এস এম পারভেজ। ৬০-এর দশকে এই চিত্রালীর মাধ্যমেই সাংবাদিকতায় আসেন এটিএম আব্দুল হাই।
তিনি আরো কাজ করেছেন- মাসিক ঝিনুক, সচিত্র সন্ধানী, সাপ্তাহিক সিনেমা, দৈনিক ভোরের কাগজ-এ। দৈনিক প্রথম আলোর উপ-সম্পাদক হিসাবে সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করেছেন মৃত্যুর আগপর্যন্ত।

আমাদের দেশের চলচ্চিত্র সাংবাদিকতায় স্টুডিও প্রতিবেদনের পথিকৃৎ তিনি। চিত্রালী’র স্টুডিওর সদরে-অন্দরে বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে, তিনি নিয়মিত চলচ্চিত্র বিষয়ক রিপোর্টিং করতেন। চিত্রালী’র সবচেয়ে জনপ্রিয় বিভাগ ছিল- আপনাদের চিঠি পেলাম। এই বিভাগটি জনপ্রিয় হওয়ার পিছনের কারিগরও এটিএম আব্দুল হাই (যিনি উত্তরদা হিসেবে অধিক পরিচিত)। বিভাগটিতে একজন পাঠক তাঁর ব্যক্তিগত সমস্যা, মতামত, আবেগ-অনুভূতিসহ নানা প্রশ্ন করতে পারেতেন/করতেন। আর এসব পাঠকদের চিঠির প্রাণবন্ত, বুদ্ধিদীপ্ত, রসাত্মক ও চমকপ্রদ জবাব দিতেন তিনি, উত্তরদা- নামের আড়ালে। তিনি ছিলেন উচুমানের রসবোধসম্পন্ন ও সহিষ্ণু টাইপের মানুষ। পাঠকদের জটিল কিংবা কুটিল প্রশ্নেও কখনোই রেগে যেতেন না। বরঞ্চ বুদ্ধিদীপ্ত সরস, চিত্ত্বাকর্ষক উত্তর প্রদানের মাধ্যমে তখনকার তরুণ-তরুণী পাঠক-লেখকদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনা এবং শিল্পের, নান্দনিক সৃজনশীলতার সুস্থবোধ বিনির্মাণের সহায়ক ভূমিকা পালন করতেন। এমন কোন প্রশ্নই ছিল না, যার উত্তর তাঁর কাছে নেই! মনে হতো উত্তরের ফ্যাক্টরি যেনো তিনি। প্রশ্ন করা মাত্র/লেখা মাত্র জবাব রেডি। সেসময়ে তাঁর ভক্ত-অনুরাগী ছিল অসংখ্য। হাজারো পাঠক-লেখকদের মধ্যে আমিও ছিলাম একজন তাঁর গুণমুগ্ধ অনুরাগী।

‘চিত্রালী’ পত্রিকাটি তখনকার সময়ে কোলকাতার বাঙালীদের কাছেও সমাদৃত ছিলো এবং ‘আপনাদের চিঠি পেলাম’ পাতাটি সেখানেও খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। কোলকাতার পাঠকদের কাছ থেকেও এই বিভাগে প্রচুর চিঠিপত্র আসতো।

বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠিত-স্বনামধন্য লেখক আছেন যার প্রথম লেখা ছাপা হয়েছিল উত্তরদার এই আপনাদের চিঠি পেলাম পাতায়।

তাঁরই বদন্যতায় ‘চিত্রালী’র এই পাতাটি এতোটাই জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিল যে, এটাকে ঘিরে একটা লেখক-পাঠকগোষ্ঠী তৈরি হয়ে গিয়েছিলো। তৈরি হয়েছিল ‘চিত্রালী পাঠক-পাঠিকা চলচ্চিত্র সংসদ (চিপাচস)’। যার প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন, আমাদের বিনোদন সাংবাদিকতার উজ্জল নক্ষত্রদের অন্যতম এটিএম আব্দুল হাই (উত্তরদা)।

এক সময়ে চলচ্চিত্র সাংবাদিকতায় তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল রীতিমতো ঈর্ষনীয় পর্যায়ে। চলচ্চিত্র সাংবাদিক তথা চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সকল কলা-কূশলী অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কাছে তাঁর সন্মান ছিল বেশ উঁচুস্থানে।
তরুণ বয়সে চলচ্চিত্রে নায়ক হিসেবে অভিনয় করার অনেক প্রস্তাবই পেয়েছিলেন সুদর্শন এটিএম হাই। কিন্তু তিনি তা সবিনয়ে প্রত্যাখান করেছেন। তবে একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি, ‘চিত্রসাংবাদিক হাই সাহেব’ নাম ভূমিকায়। চিত্রগ্রাহক-পরিচালক কিউ এম জামানের বিশেষ অনুরোধে ‘ছদ্মবেশী’ ছবিতে।
পরবর্তিতে ছোট পর্দায় মডেল হিসেবে এবং জনপ্রিয় ব্যান্ডসংগীতশিল্পী জেমস-এর ‘বাবা’ শিরোনামের একটি গানের ভিডিওচিত্রে বাবা’র ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তিনি। জানা যায় তিনি একবার রেডিওতে গানও গেয়েছিলেন। তবে তাঁর পারিবারিক বিধিনিষেধ থাকার কারনেই, অভিনয় বা গান কোনটাই আর হয়ে ওঠেনি।
নামে-বেনামে তিনি বেতার ও টেলিভিশনের জন্য কিছু স্ক্রিপ্ট লিখেছেন। লিখেছেন চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্টও ।

এটিএম হাই ছিলেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস)-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের অন্যতম একজন।

১৯৭২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ঢাকাস্থ সোভিয়েত দূতাবাস-এর প্রেস ইনফরমেশন বিভাগে দীর্ঘ ১৮ বছর চাকুরী করেছেন এটিএম আব্দুল হাই। চাকুরীকালীন সময়ে মস্কো সফরেও গিয়েছিলেন। সোভিয়েত দূতাবাসের প্রেস ইনফরমেশন বিভাগের প্রধান হিসাবে অবসর গ্রহণ করে ছিলেন তিনি।

ব্যক্তিজীবনে এটিএম আব্দুল হাই ১৯৫৭ সালে, গাজী ফাতেমা ওরফে হেনার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন (তাঁর স্ত্রী একসময় ছোটগল্প লিখতেন এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথেও জড়িত ছিলেন)। তাদের চার সন্তান- তিথি, তুহিন, তমাল আর তানি।

চলচ্চিত্র তথা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গণের সুহৃদ এটিএম আব্দুল হাই ছিলেন প্রচার বিমুখ এক সাদা মনের ভালো মানুষ। তাঁর নিজের নামটি কোথাও প্রচারিত হোক তা তিনি কখনই চাইতেন না। অসম্ভব রকমের বিনয়ী, মৃদুভাষী, সদা মিষ্টহাসী, স্মার্ট, সুদর্শন, সুপুরুষ-এক অনুকরণীয়-অনুস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব।

এই প্রতিভাবান মেধাবী চলচ্চিত্র সাংবাদিককে আজ আমরা ভুলেই গেছি প্রায়। তাইতো তাঁর প্রয়াণ দিবসে তাঁকে স্মরণ করার প্রয়োজন মনি করি না আমরা। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এক কলাম লিখিও না আমরা। আমাদের সাংবাদিকদের যে সংগঠনগুলো আছে তাদের স্মরণেও থাকে না, এসব বিশিষ্ট গুণি সাংবাদিকদের মৃত্যুবার্ষিকীর দিন-ক্ষণ। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস)ও কি, তাঁকে স্মরণ করে, শ্রদ্ধা জানায়! জানা নেই আমার ।

তখনকার সময়ে আমাদের সব চিত্রালী পাঠক-পাঠিকাদের কাছে তিনি যে, কি ছিলেন তা ভাষায় প্রকাশ করা আমার জন্য খুবই দুরহ। কি ছিলেন না তিনি আমাদের!
আমা‌দের স্বপ্নের আকা‌শে নীল ধ্রুবতারা ছিলেন তিনি, উজ্জ্বলতম এক নক্ষত্র ছিলেন তিনি, আমা‌দের ভবিষ্যতের অনু‌প্রেরণা ছিলেন তিনি, জীবন চলার পথে দিক নি‌র্দেশক ছিলেন তিনি, অন্ধকার জীবনের আ‌লোকবর্তিকা ছিলেন তিনি, ভা‌লোবাসায় পরিপূর্ণ এক দেবতুল্য মানুষ‌ ছি‌লেন তিনি, ছিলেন আমা‌দের অতি আপনজন, আত্মার আত্মীয়, আমাদের অতি প্রিয়জন শ্রদ্ধাভাজন- উত্তরদা।

আজও তাঁর কথা ম‌নে পড়‌লে মনের আকাশে ভেসে ওঠে অসাধারণ একজন সাদা মনের ভালো মানুষের ছবি । কত অনিন্দ্য সুন্দর সময় কেটেছে তাঁর উপস্থিতে-তাঁর সান্নিধ্যে। সমস্যা-সংকুলে বা কোন কঠিনতম প্রশ্নের মুখোমুখি হলে, কোনো সমাধান না পেলে, তখনই মনে পরে যায় প্রিয় সেই আপন মানুষটির কথা। মনে হয়- আহারে যদি তিনি বেচেঁ থাকতেন, তবে এ সমস্যার/প্রশ্নের সুন্দর সমাধান অবশ্যই পেতাম তাঁর কাছ থেকে ।
তাঁর শূন্যতায় হৃদয় হাহাকা‌র করে। তাঁকে না দেখে চোখ ভি‌জে কাঁ‌ন্নায়। অপ‌রিসীম এক কষ্টের সুর প্রাণে বাঁজে অহর্নিশি।

অনন্তলোকে ভালো থাকুন আমাদের শ্রদ্ধাভাজন প্রিয়জন- উত্তরদা, মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে এই প্রার্থনা করি।

Notify of
guest
0 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরাতন
সবচেয়ে নতুন Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Advertisements
সর্বশেষ
- Advertisements -
এ বিভাগে আরো দেখুন