স্বনামখ্যাত চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিবেশক-প্রদর্শক ইফতেখারুল আলম-এর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০১৯ সালের ৫ জানুয়ারি, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। প্রয়াত ইফতেখারুল আলম-এর স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা। তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি প্রার্থনা করি।
খ্যাতিমান চলচ্চিত্র প্রযোজক ইফতেখারুল আলম ১৯২৭ সালের ১৩ অক্টোবর, ভারতের আসানসোলের, মেদিনীপুরে জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করেন ১৯৪৭ সালে । সে সময়ে লেখক অনুবাদক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন তিনি । ১৯৪৮ সালে চলচ্চিত্রের ব্যবসার সাথে জড়িত হন।
১৯৫০ সালে ‘স্টার ফিল্ম ডিসট্রিবিউটার’ নামে শুরু করেন চলচ্চিত্র পরিবেশনা সংস্থাটি। এই সংস্থার প্রথম ছবি ‘রামভক্ত হনুমান’। পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু , বোম্বের হিন্দি, কলকাতার বাংলা ও ইংরেজী ছবির পরিবেশক ছিল তাঁর ‘স্টার ফিল্ম ডিসট্রিবিউটার’।
১৯৬২ সালে ‘নতুন সুর’ ছবি’র মাধ্যমে, প্রথম চলচ্চিত্র প্রযোজক হন তিনি। তাঁর প্রযোজনা-পরিবেশনা সংস্থার অন্যান চলচ্চিত্রসমূহ- ‘সোনার কাজল’, ‘কাচের দেয়াল’, ‘প্রীত না জানে রীত’, ‘রাজা এলো শহরে’, ‘সঙ্গম’, ‘মেঘ ভাঙ্গা রোদ’, ‘এই তো জীবন’, ‘মিলন’, ‘কাজল’, ‘বাহানা’, ‘নদী ও নারী’, ‘রহিম বাদশা ও রুপবান’, ‘ঘর কি লাজ’, ‘ফির মিলেঙ্গে হাম দোনো’, ‘ভাওয়াল সন্নাসী’, ‘ইন্ধন’, ‘বেগানা’, ‘বেহুলা’, ‘আখেরী ষ্টেশন’, ‘পরওয়ানা’, ‘আলীবাবা’, ‘আনোয়ারা’, ‘আগুন নিয়ে খেলা’, ‘দুই ভাই’, ‘কাঞ্চন মালা’, ‘সাউফুলমুলক বদিউজ্জামাল’, ‘একালের রুপকথা’, ‘সুয়োরাণী দুয়োরাণী’, ‘সংসার’, ‘সপ্তডিঙ্গা’, ‘যাহা বাজে শেহনাই’, ‘মোমের আলো’, ‘চম্পাকলী’, ‘আগন্তুক’, ‘নতুন ফুলের গন্ধ’, ‘পিয়াসা’, ‘স্বর্ণকমল’, ‘পায়েল’, ‘বাবলু’, ‘যোগ বিয়োগ’, ‘রাজ মুকুট’, ‘মিশর কুমারী’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’, ‘ওরা ১১ জন’, ‘ধীরে বহে মেঘনা’, ‘বড় বাড়ীর মেয়ে’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘আবে হায়াত’, ‘নরম গরম’, ‘মহা নায়ক’, ‘রায় বিনোদিনী’ ইত্যাদি।
ইফতেখারুল আলম ১৯৫১ সালে, পূর্বপাকিস্তান চলচ্চিত্র সমিতির সাধারন সম্পাদক ছিলেন। প্রদর্শক এবং পরিবেশক সমিতির অন্যতম নেতা হিসেবে বলিষ্ঠ ভুমিকা রেখেছেন নানাভাবে।
এদেশের চলচ্চিত্রের ব্যবসার প্রসারে বিভিন্ন জেলায় সিনেমা হল তৈরি করেন তিনি। ঢাকার বিখ্যাত ‘স্টার’, ‘মুন’, ‘রূপমহল’, ‘রাজমহল’, ‘আজাদ’ ছাড়াও ঢাকার বাইরে বেশ কয়েকটি সিনেমা হলের স্বত্বাধিকারী ছিলেন।
তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘স্টার সিনে কর্পোরেশন’, ‘স্টার কর্পোরেশন লিমিটেড’, ‘অমনিকম গ্রুপ অব কোম্পানী’ এবং ‘স্টার এ্যাডভেটাইজিং’। দেশের প্রথম প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ‘নর্থ সাউথ ইউনির্ভাসিটি’ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
ইফতেখারুল আলম ব্যবসার পাশাপাশি আর্ত-মানবতার সেবায়ও জড়িত ছিলেন, আজীবন।
বাংলাদেশ ‘জাতীয় পোলিও প্লাস কমিটি’র চেয়ারম্যান ছিলেন ইফতেখারুল আলম, তাঁর নেতৃত্বে এ কমিটির উদ্যোগে ২০০০ সালের আগস্ট-এ দেশ পোলিও মুক্ত হয়।
বাংলাদেশের বাণিজ্য ও শিল্প উন্নয়নে ইফতেখারুল আলমের অবদানকে বিভিন্নভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
তিনি ১৯৮০-৮১ সালে ‘ফেডারেশন অফ বাংলাদেশ চেম্বারস অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’র সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ‘বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনে’র সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
ইফতেখারুল আলম ‘বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি’ এবং ‘বাংলাদেশ হার্ট ফাউন্ডেশনে’র আজীবন সদস্য ছিলেন। তিনি ঢাকা আহসানিয়া মিশনের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যও ছিলেন।
স্কাউটিং আন্দোলনে অবদানের জন্য, ইফতেখারুল আলমকে ‘সিলভার টাইগার’ পদকে ভূষিত করা হয়।
কিংবদন্তিতুল্য চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিবেশক-প্রদর্শক ইফতেখারুল আলম, যিনি সিনেমার মানুষদের কাছে ‘কিসলু ভাই’ হিসেবে অধিক পরিচিত ছিলেন। তাঁর প্রযোজিত অসংখ্য ছবি ও ছবি’র শিল্পী-কলাকুশলী জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন, তিনিও পেয়েছেন আজীবন সম্মাননা।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের একজন প্রকৃত সুহৃদ-অভিভাবক ছিলেন ইফতেখারুল আলম। তাঁর শূন্যতা পূরণ হবার নয়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এই মহিরুহ ব্যক্তিত্ব, বেঁচে থাকবেন-অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন, তাঁর কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে।