এ কে আজাদ: হীরেন দে। বরেণ্য ও নন্দিত চলচ্চিত্র সাংবাদিক-সমালোচক, চলচ্চিত্র সংসদকর্মী, নাট্যকর্মী, অভিনেতা, চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য-সংলাপ রচয়িতা, কবি, গল্পকার ও চলচ্চিত্রবিষয়ক ঐতিহাসিক পত্রিকা সাপ্তাহিক চিত্রালীর সম্পাদক।
অনেক গুণে গুণান্বিত এই মেধাবী সাংবাদিক, চলচ্চিত্র তথা আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মানুষদের কাছে অতি ভদ্র-ভালো মানুষ হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন।
আমাদের চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার এই গুণী ব্যক্তিত্ব হীরেন দের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ । তিনি ২০২২ সালের ২০ নভেম্বর (১৯ নভেম্বর রাত ১২টার পর) রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। প্রয়াত এই গুণী মানুষটির স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।
হীরেন দে (প্রদীপ কুমার দে বাবলু) ১৯৫১ সালের ৭মে, গাইবান্ধা শহরের কালি বাড়ী পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ধীরেন্দ্রনাথ দে ও মাতার নাম সুধা রানী দে। ধীরেন্দ্রনাথ দে উচুঁ মানের একজন মৃৎশিল্পী ছিলেন। স্বরস্বতী পূজার সময় তিনি খুব সুন্দর সুন্দর স্বরস্বতী প্রতিমা তৈরী করতেন, এছাড়াও দূর্গা প্রতিমাও তৈরী করতেন বলে জানা যায়। এগারো ভাই-বোনের মধ্যে হীরেন দে ছিলেন সবার বড়।
অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে স্থানীয় স্কুলে প্রাইমারি শিক্ষা সমাপন করে, ১৯৬২ সালে শহরের ইসলামিয়া স্কুলে ক্লাশ সিক্সে ভর্তি হন হীরেন দে। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন প্রচণ্ড মেধাবী, যার স্বাক্ষর রেখেছেন শিক্ষা ও কর্মজীবনের প্রতিটি স্তরে।
হাইস্কুল জীবন থেকেই তিনি টিউশনি করা শুরু করেন, জানা যায় তাঁর সহপাঠিদেরকে পর্যন্ত পড়াতেন, এমনই মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি।
হীরেন দে তখনকার সময়ে প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তাঁর হাতের লেখা খুবই সুন্দর ছিল, তাই আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলন এবং মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে, সেই উত্তাল সময়ে পোস্টার ও দেয়াল লিখনের কাজগুলো তাদের এলাকায় তিনিই করতেন। ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে তিনি আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধেও বিশেষ ভূমিকা রেখে ছিলেন বলে জানা যায়।
কলেজের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায়ই তিনি নিয়মিত দেয়াল পত্রিকা বের করতেন। গাইবান্ধা শহরের সেই সময়ের দুইটি সিনেমা হল- ‘মায়া’ ও ‘চৌধুরী টকিজ’-এ প্রদর্শিত বিজ্ঞাপনগুলোর স্লাইডও তিনি তৈরী করে দিতেন বলে জানা গেছে।
হীরেন দে শৈশবকাল থেকেই নাট্যাভিনয়ের সাথে জড়িত ছিলেন, তিনি শিশু নাট্যশিল্পী হিসেবে গাইবান্ধা নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (গানাসাস-তখনকার জিসিডিসি)-এর নাটকে অভিনয় করতেন। ইসলামিয়া স্কুলের শিক্ষার্থী থাকা কালীন, স্কুলটির সহকারী প্রধান শিক্ষক ও খ্যাতিমান নাট্যকলাবিদ প্রণব কুমার বক্সীর পরিচালনায় প্রতিবছর তাদের স্কুলের বার্ষিক নাটকের প্রধান চরিত্রের অভিনেতা থাকতেন হীরেন দে।
পরবর্তিতে ঢাকায় এসে যুক্ত হন, ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে। একসময় থিয়েটারের হয়ে নিয়মিত মঞ্চে অভিনয় করেছেন।আশির দশকে থিয়েটার ভাগ হলে, তিনি আরামবাগ থিয়েটার-এর সাথে যুক্ত থাকেন। সেই সময়ে আরামবাগ থিয়েটার-এর দুইটি মঞ্চসফল নাটক ‘জমিদার দর্পণ’ ও ‘সাত ঘাটের কানাকঁড়ি’ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ সফর করেন হীরেন দে।
১৯৬৭-’৬৯ সালে গাইবান্ধা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালীন সময় থেকে তিনি সাপ্তাহিক চিত্রালীতে সাংস্কৃতিবিষয়ক সংবাদ পাঠাতেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই হীরেন দে পড়াশুনার পাশাপাশি ‘চিত্রালী’তে শিক্ষানবীশ প্রতিবেদক-প্রদায়ক হিসেবে কাজ শুরু করেন।
১৯৭৩-’৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে হীরেন দে তাঁর প্রিয় পত্রিকা চিত্রালীতে সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন ।
পরবর্তিতে তিনি চিত্রালীর নির্বাহী সম্পাদক ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে বহু বছর দায়িত্ব পালন করেছেন।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি হীরেন দে বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখিতেও ছিলেন পারদর্শী। তিনি গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক ও চলচ্চিত্রের জন্য কহিনী-চিত্রনাট্য-সংলাপ লিখেছেন। তাঁর লেখা কয়েকটি বইও প্রকাশিত হয়েছে।
তিনি যেসব চলচ্চিত্রের কহিনী-চিত্রনাট্য-সংলাপ লিখেছেন তারমধ্যে- বেদ্বীন, চিৎকার, নয়নের আলো, রাজিয়া সুলতানা, সাত রাজার ধন, জীবনধারা, বীরাঙ্গনা সখিনা, ঘর ভাঙ্গা ঘর, উল্লেখযোগ্য।
হীরেন দে একজন ভালো অভিনেতাও ছিলেন। মঞ্চের পাশাপাশি তিনি টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। বেদ্বীন, মানে না মানা, সোহাগ মিলন, ভাগ্যলিপি, অন্ধবধূ, প্রিন্সেস টিনা খান, হাসনা হেনা, রাধাকৃষ্ণ’সহ আরো বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
হীরেন দের সাংগঠনিক দক্ষতা ছিলো অসাধারণ, তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস)’র সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন।
দায়িত্ব পালন করেছেন থিয়েটার-এর সভাপতি হিসেবেও।
হীরেন দে বিয়ে করেন, শিক্ষিকা শ্রীমতী গীতা মজুমদারকে। তাদের একমাত্র কন্যা রাত্রি দে প্রকৌশলী এবং জামাতা অতনু পাল ডাক্তার।
বরেণ্য সাংবাদিক হীরেন দে, সাংবাদিকতায় ফজলুল হক স্মৃতি পুরস্কার লাভ করেন ২০০৭ সালে।
স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র হীরেন দে
পড়ালেখা শেষ করে, নানা আকর্ষনীয় চাকুরীর প্রস্তাবকে পাশ কাটিয়ে তাঁর প্রিয় পেশা সাংবাদিকতায় আসেন।
সংস্কৃতিবান ও চলচ্চিত্রপ্রেমী হীরেন দে এক সময় চিত্রালীর সাথে সুনিবিড় সম্পর্কে জড়িয়ে যান।
চিত্রালী অন্তপ্রাণ হীরেন দের চিন্তায়-চেতনায়, মেধায়-মননে সমৃদ্ধ হয়েছে আমাদের চলচ্চিত্র তথা শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগত।
হীরেন দে শারীরিকভাবে এই পৃথিবীতে নেই। কিন্তু আছে তাঁর চিন্তা-চেতনা, আছে তাঁর সৃজনশীল কর্ম, এই কর্মের মাধ্যমেই তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।