এ কে আজাদ: খন্দকার ফারুক আহমদ। একজন প্রথিতযশা কন্ঠশিল্পী। অসম্ভব রোমান্টিক শ্রুতিমধুর কন্ঠের অধিকারী ছিলেন খন্দকার ফারুক আহমদ । চলচ্চিত্র-বেতার-টেলিভিশন সব মাধ্যমেই সফল-সাবলীল বিচরণ করেছেন। নিজের মেধা ও কন্ঠের যাদুতে সঙ্গীতবোদ্ধাদের পছন্দের কন্ঠশিল্পী ছিলেন তিনি। এই গুণী সঙ্গীতশিল্পীর মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০০১ সালের ১১জুলাই, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন । মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬১ বছর। গুণি সঙ্গীতশিল্পী খন্দকার ফারুক আহমদ-এর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
প্রতিভাবান কন্ঠশিল্পী খন্দকার ফারুক আহমদ ১৯৪০ সালের ১ জানুয়ারি, বগুড়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ছিলেন পুলিশ অফিসার, তাঁর বদলির চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন জেলায় থেকেছেন। লেখা-পড়া করেছেন বগুড়া জিলা স্কুল, রাঙামাটি জিলা স্কুল এবং শেষে ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন।
ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল। প্রিয় কন্ঠশিল্পী মান্না দের গান শুনে শুনে, নিজে গান শিখতে শুরু করেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন সরকারের কাছে। পরে ওস্তাদ মিথুন দের কাছেও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দীক্ষা নেন খন্দকার ফারুক আহমদ ।
১৯৬১ সালে, ঢাকা রেডিওতে অডিশন দিয়ে পাস করেন এবং সেই থেকেই রেডিওতে গান গাওয়া শুরু । আমাদের দেশে টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকেই গান করছেন খন্দকার ফারুক আহমেদ ।
১৯৬৭ সালে, মুক্তিপ্রাপ্ত মিতা পরিচালিত ‘চাওয়া পাওয়া’ ছবিতে কন্ঠ দেওয়ার মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক শুরু করেন । ফারুক আহমেদ আরো যেসব ছবিতে গান গেয়েছেন তারমধ্যে আছে- আবির্ভাব, এতটুকু আশা, নীল আকাশের নিচে, দীপ নেভে নাই, জীবন সাথী, চোরাবালি, সন্তান, সাধারণ মেয়ে, সমাধান, কোথায় যেন দেখেছি, যৌতু্ক, পিঞ্জর, ছদ্মবেশী, উপহার, অমর প্রেম, স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা, আলোর মিছিল, অবাক পৃথিবী, মালকা বানু, অশিক্ষিত, অলংকার, লাল কাজল, প্রভৃতি।
খন্দকার ফারুক আহমদের কিছু জনপ্রিয় কালজয়ী গান- নীল আকাশের নীচে আমি রাস্তা চলেছি একা…, রিকশাওয়ালা বলে কারে তুমি আজ ঘৃণা কর.., আমি নিজের মনে নিজেই যেন গোপনে ধরা পড়েছি…, আমার এ গান তুমি শুনবে জানি শুনবে…, কোথায় তোমায় যেন দেখেছি…, আমার বউ কেন কথা কয় না.., বাসন্তী রং শাড়ী পড়ে.., সেদিন তুমি কি যেন কি ভাবছিলে.., জীবনের বাতায়নে কতবার অকারণে আঁখী মেলে রেখেছি.., তুমি যদি একটু থাকো আমার পাশে.., কাছে এসো যদি বলো তবে দূরে কেন থাকো.., নীল নীল আহা কত নীল তোমার ও দুটি চোখ.., তোমার এ উপহার আমি চিরদিন রেখে দেব.., শুধু একবার বলে যাও আমি যে তোমার কত প্রিয়.., আমি কার জন্য পথ চেয়ে রব.., ঢাকা শহর আইসা আমার আশা পুরাইছে.., প্রেম যেন এক ছোট্ট চিঠি.., দিন বদলের দিন এসেছে কান পেতে ঐ শোন…, ইত্যাদি।
খন্দকার ফারুক আহমদ ১৯৬৮ সালে, চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান সম্পাদিত দ্যা এক্সপ্রেস পত্রিকার পাঠকদের ভোটে শ্রেষ্ঠ টিভি গায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন । ‘রিকশাওয়ালা বলে কারে তুমি আজ ঘৃণা কর..’- গানটি তখনকার সময়ে শ্রমজীবী মানুষদের আন্দোলনে ব্যাপক জোয়ার এনেছিল। এই গানটির জন্য মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী, শিল্পী খন্দকার ফারুক আহমদকে পল্টন ময়দানে লক্ষাধিক মানুষের জনসভায় সোনার মেডেল পরিয়ে সম্মানিত করেছিলেন। ১৯৭৪ সালে, ‘আলোর মিছিল’ ছবিতে ‘দিন বদলের দিন এসেছে কান পেতে ঐ শোন…’- গানটির জন্য শ্রেষ্ঠ কন্ঠশিল্পী হিসেবে বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি (তখনো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তন হয়নি)। ‘আমি যে পথিক দেখেছি..’- গানটি গাওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংস্থা কর্তৃক হাণ্টিং সিঙ্গার খেতাবে ভূষিত হন তিনি, ১৯৮০ সালে। শেরে বাংলা পদক, ভাসানী পদক, ঋষিজ পুরস্কার’সহ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন খন্দকার ফারুক আহমদ ।
অসম্ভব রোমান্টিক শ্রুতিমধুর কন্ঠের অধিকারী ছিলেন খন্দকার ফারুক আহমদ । চলচ্চিত্র-বেতার-টেলিভিশন সব মাধ্যমেই সফল-সাবলীল বিচরণ করেছেন। খ্যাতি-যশ-জনপ্রিয়তাও পেয়েছেন অনায়াসে। সঙ্গীতবোদ্ধাদের পছন্দের কন্ঠশিল্পী ছিলেন তিনি। নিজের মেধা ও কন্ঠের যাদুতে সঙ্গীতের এক অনন্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত, খন্দকার ফারুক আহমদ। চিরঞ্জীব- সঙ্গীতশিল্পী খন্দকার ফারুক আহমদ।