এ কে আজাদ: রাজা হোসেন খান। সুরকার-সংগীত পরিচালক-যন্ত্রসংগীত শিল্পী। বাংলাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতপরিবারের সদস্য রাজা হোসেন খান। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী ‘খান’ পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই এই উপমহাদেশের খ্যাতিমান সঙ্গীতজ্ঞ।
বাংলাদেশের সঙ্গীতে তাঁর পরিবারের সদস্যদের রয়েছে অনন্য অবদান। তিনি নিজেও তাঁর কর্মের মাধ্যমে এদেশের সঙ্গীতকে সমৃদ্ধ করে গেছেন।
খ্যাতিমান সুরকার-সঙ্গীতপরিচালক রাজা হোসেন খান এর মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি আজ থেকে ৩৫ বছর আগে, ১৯৮৯ সালের ৬ মার্চ, মাত্র ৫১ বছর বয়সে, মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। প্রয়াত এই গুণী সঙ্গীতজ্ঞর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
রাজা হোসেন খান ১৯৩৮ সালে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংগীত পরিবারে জন্ম নেয়া রাজা হোসেন খান, তাঁর পিতা নায়েব আলী খান এর সাথে বেহালা বাজিয়ে প্রথম সংগীত চর্চা শুরু করেছিলেন। পরে তিনি তাঁর চাচাতো ভাই বাহাদুর খানের কাছ থেকে উচ্চ প্রশিক্ষণ নিতে কলকাতায় যান, সেখানে তিন বছর পড়াশোনা করেন। এরপরে তাঁর আরেক চাচাত ভাই আলি আকবর খান এবং তাঁর বড় ভাই খাদেম হোসেন খান এর কাছ থেকে সংগীত এর উপর দীক্ষা নেন।
কিংবদন্তী বাদ্যযন্ত্রশিল্পী ও সংগীত শিক্ষক আলাউদ্দিন খাঁ এবং আয়েত আলী খাঁ, রাজা হোসেন খান এর চাচা এবং প্রখ্যাত সুরকার-সংগীত পরিচালক শেখ সাদী খান তাঁর চাচাতো ভাই ।
তৎকালিক ঢাকা রেডিওতে ‘স্টাফ আর্টিস্ট’ হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে রাজা হোসেন খান তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তিতে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) এর জন্য প্রচুর কাজ করেছেন। বিটিভি’র বহু জনপ্রিয় গানে সুর করেছেন। তিনি সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসাবে বিভিন্ন দেশ পরিদর্শন করেছেন।
বাংলাদেশের অনেক চলচ্চিত্রের সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছেন রাজা হোসেন খান। চলচ্চিত্রে প্রথম দিকে এককভাবে সুর ও সংগীত পরিচালনা শুরু করলেও পরবর্তিতে, তাঁর সহযোগী সুজেয় শ্যাম এর সাথে যৌথভাবে কাজ করেন তিনি। যৌথভাবে তাদের নাম হয় ‘রাজা শ্যাম’।
রাজা হোসেন খান (রাজা শ্যাম) যেসব চলচ্চিত্রে সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছেন তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য-
ঢেউয়ের পরে ঢেউ, সাধু শয়তান, সোনার খেলনা, বালা, ভুল যখন ভাঙলো, বিচারপতি, মেঘের পরে মেঘ,
সূর্যগ্রহণ, সূর্যসংগ্রাম, শাস্তি, প্রভৃতি।
‘সুর্যগ্রহণ’ ছবিতে সংগীত পরিচালনার জন্য রাজা হোসেন খান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন।
রাজা হোসেন খান এর সুর করা কিছু জনপ্রিয় গান- সুচরিতা যেও নাকো কিছুক্ষণ থাকো…., ঐ আকাশ ঘিরে সন্ধ্যা নামে…., পথ চীরো দিন সাথী হয়ে রয়েছে আমার…, সুখ সাগরে ভাসলাম না সই ভাসলাম চোখের জলে…, ঐ আকাশ ঘিড়ে সন্ধ্যা নামে রাতের আভাসে/কথা ছিলো পাশে থাকবে আমার হয়ে…., মানুষের গড়া সভ্যতার ধ্বংসো হবে একদিন…, সাদা কাগজটার মূল্য কী আছে যদি তাতে কিছু লেখা না থাকে…, সব কিছু মোর উজাড় করে দিয়েছি তোমায় তুলে/কেমোনে গেলে ভুলে…, খোলা জানালায় চেয়ে দেখি তুমি আছো…., অলঙ্কারের মূল্য দিয়ে মন কেনা যায় ভেবো না…, বেদনার রং যদি নীল আকাশটা নীল হলে দুটি চোখ কেন খুশি হয়…, এভাবেই দুটি মন কাছে আসে ভালোবাসে দুজনে…, আমি হার মেনেছি তোমার জয়ের কাছে হার মেনেছি দেখো হাসিমুখে…, ইত্যাদি।
খুব ভালো একজন যন্ত্রসংগীত শিল্পীও ছিলেন রাজা হোসেন খান । বাংলাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতপরিবারের সদস্য ছিলেন রাজা হোসেন খান। সঙ্গীতজগতে নিজেও ছিলেন স্বনামখ্যাত জনপ্রিয় সুরকার- ঙ্গীতপরিচালক। আধুনিক বাংলা গান ও চলচ্চিত্রের গান, সব ধরণের গানই তাঁর সুরে হয়ে যেত ব্যঞ্জনময়। বাংলাদেশ তথা এই উপমহাদেশীয় সঙ্গীতে তাঁর এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের অনন্য অবদান অবিস্মরণীয়।
গুণী সঙ্গীতজ্ঞ রাজা হোসেন খান অনন্তলোকে ভালো থাকুন- এই প্রার্থণা করি।
(ছবি কৃতজ্ঞতা- খ্যাতিমান গীতিকবি মুনশী ওয়াদুূদ)