আজাদ আবুল কাশেম: গীতিকবি-সুরকার-সঙ্গীত পরিচালক-কন্ঠশিল্পী কুটি মনসুর এর পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০১৭ সালের ২৪ জানুয়ারী, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। মৃত্যুদিবস-এ প্রয়াত কুটি মনসুরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
কুটি মনসুর (মোঃ মনসুর আলী খান) ১৯২৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর, ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসন উপজেলার লোহারটেক গ্রামে, জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম, মোঃ মনসুর আলী খান। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট হওয়ায়, মায়ের আদর করে ডাকা নাম ‘কুটি মনসুর’। যে নামে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। কুটি মনসুরের পিতা আবেদ আলী খান ও মাতা আবেদুন্নেসা। তিনি ১২ বছর বয়স থেকে সঙ্গীতে তালিম গ্রহণ শুরু করেন এবং ১৫ বছর বয়সেই নিজে গান রচনা করে তাতে সুর সংযোজন করে বিভিন্ন মঞ্চে নিজেই গাইতে শুরু করেন।
তিনি ১৯৫৯ সালে মৎস্য অধিদফতরে চাকরিতে যোগদান করেন। ১৯৬২ সালে কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার ও সুরকার হিসেবে বেতারে তালিকাভুক্ত হন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকে গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। ১৯৮২-১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ পরিদফতরের অধীনে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে উদ্বুদ্ধকরণের নিমিত্তে তাঁর রচিত ৩০০ গান দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাউল শিল্পীদের প্রশিক্ষণের কাজ করেছেন। তিনি বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের কণ্ঠশিল্পী অডিশন বোর্ডের সম্মানিত বিচারক হিসেবেও দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া বঙ্গবন্ধু ললিতকলা একাডেমিতে ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত অধ্যক্ষ হিসেবে এবং আনসার ভিডিপিতে ১৯৯৭-২০০২ সাল পর্যন্ত সঙ্গীত প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও দেশাত্ববোধক প্রচুর গান ও কবিতা রচনা করেছেন কুটি মনসুর। মায়ের মুখের বাংলা ভাষা…, রক্ত দিয়ে ইতিহাস লিখে গেল যারা…., আটই ফালগুনের কথা…, এই তো আমার দেশ…, বাংলাদেশের মতো এমন দেশ তো কোথাও নাই…, আমার দেশের ছয়টি ঋতু…., সখিনাকে একা রেখে যুদ্ধে চলে যাই…., জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু, বলরে সবাই বল…, বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী সন্তান…, বঙ্গবন্ধু একটি নাম…., মুজিব মরে নাই…,-তাঁর লেখা এসব গান তখনকার সময়ে এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে, মানুষের মুখে মুখে ফিরত।
তিনি বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় ৮ হাজার গান রচনা এবং ৪ হাজার ৫০০ গানের সুরারোপ করেছেন। তাঁর রচিত ও সুরারোপিত প্রায় আড়াইশত গান, ঢাকা রেকর্ড ও ইপ্সা রেকর্ড নামের দুটি গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে লং প্লে ডিস্ক রেকর্ডে প্রকাশ হয়েছে।
কুটি মনসুর ষাট, সত্তর ও আশির দশকে এদেশের আধুনিক বাংলা ও লোকজগানের জগতে অতি সুপরিচিত একটি নাম। তিনি দীর্ঘ ৬০ বছরের সঙ্গীতজীবনে পল্লিগীতি, আধুনিক, জারি-সারি, পালাগান, পুঁথিপাঠ, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, মারফতি, আধ্যাত্মিক, দেহতত্ত্ব, হামদ-নাত, ইসলামি প্রভৃতি বিষয়ে হাজার হাজার গান লিখেছেন । তাঁর লেখা অনেক গানই পেয়েছে জনপ্রিয়তা, রয়েছে কালজয়ীর তালিকায়। এসব গান আজও বাংলাদেশের মানুষের মুখে মুখে ফেরে। এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গান হলো— ‘আইলাম আর গেলাম….’, ‘যৌবন জোয়ার একবার আসে রে….’, ‘আমি কি তোর আপন ছিলাম না রে জরিনা…’, ‘বিধিরে এই মানুষের ভিতর কেন বানাইলা অন্তর…’, ‘কে বলে প্রেম নেই…’, ‘রক্তে লেখা প্রেমের চিঠি… ‘, ‘ইছামতি নদীর পাড়ে ছোট্টএকটি গ্রাম…’, ‘বুকের মাঝে সুখের বাসা…’, ‘কে বলে মানুষ মরে…’, ‘হিংসা আর নিন্দা ছাড়ো…’, ‘সাদা কাপড় পরলে কিন্তু মনটা সাদা হয় না…’ প্রভৃতি।
কুটি মনসুর চলচ্চিত্রের জন্যও গান লিখেছেন। তিনি এফ কবির চৌধরীর ‘শীষনাগ’ ও মইনুল হোসেনের ‘যোগাযোগ’সহ বেশ কিছু ছবির জন্য গান লিখেছেন। প্রামাণ্যচিত্র ‘দুই বিঘা জমি’তে তিনি গান লেখার পাশাপাশি নিজে কন্ঠও দেন। এছাড়াও তাঁর লেখা জনপ্রিয় কিছু গান আছে, যা পরবর্তিতে কয়েকটি চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা হয়েছে।
কুটি মনসুর সাহিত্য চর্চায়ও মনোযোগী ছিলেন। তাঁর লেখা ছড়া-কবিতা দেশের বিভিন্ন পত্রিকা ও সাময়িকীতে প্রকাশ হয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি পাঁচটি বই লিখেছেন। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে- ‘মীন গীতিকা’ (মৎস্য উন্নয়নে উদ্বুদ্ধকরণের গান ও কবিতা সম্বলিত বই), ‘পরিবার-পরিকল্পনার গান’ (জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে উদ্বুদ্ধকরণের বই), ‘কুটি মনসুরের অমর সঙ্গীত’, ‘কুটি মনসুরের ভান্ডারী গান’, এবং ‘আমার বঙ্গবন্ধু আমার ৭১’।
সঙ্গীতে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বিভিন্ন সংস্থা থেকে পেয়েছেন নানা পুরস্কার ও সম্মাননা। যার মধ্যে- শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার ২০০৪, ঋষিজ শিল্পগোষ্ঠী পুরস্কার ১৪১১ বাং, খেলা ঘর জাতীয় শিশু-কিশোর সাংস্কৃতিক উৎসব পুরস্কার ২০১০ ও লোকাঙ্গন সাংস্কৃতিক সংগঠন পুরস্কার ২০১৪ অন্যতম।
ব্যাক্তিজীবনে কুটি মনসুর, ঢাকা জেলার দোহার থানার মীর সৈয়দ আলীর জ্যেষ্ঠ কন্যা জাহানারা বেগমের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের ছয় সন্তান। তাঁরা হলেন- খান মোহাম্মদ মজনু (ফটো সাংবাদিক), জাহিদ মনসুর (সুরকার ও সঙ্গীতপরিচালক), সুরাইয়া খানম, জেসমিন আক্তার, তাসলিমা আক্তার ও শাহীন সুলতানা যুথি।
কুটি মনসুর একাধারে গায়ক, গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন। ছিলেন বহুমুখী প্রতিভাবান একজন প্রথিতযশা সঙ্গীতজ্ঞ। সব ধরণের গান লিখায় ও সুর করায় তাঁর ছিল অসাধারণ পারদর্শিতা। বাংলা গানের সকল শাখায় ও মাধ্যমে তাঁর ছিল সফল বিচরণ।
কঠোর পরিশ্রম ও সাধনায় সঙ্গীতজগতে, নিজের অবস্থান নিয়ে গেছেন খ্যাতির শীর্ষে। পেয়েছেন বহুল জনপ্রিয়তা।
বাংলাদেশের সঙ্গীতশিল্পে কুটি মনসুর একটা অধ্যায়, একটা ইতিহাস। বাংলাদেশের লোকজ গানে তাঁর অনন্য অবদান চির স্মরণীয় হয় থাকবে।
বাংলা লোকজ গানের এই প্রথিতযশা সাধক ছিলেন প্রচণ্ড রকমের অন্তর্মুখী-প্রচারবিমুখ এক মানুষ। যার কারণে বাংলা সঙ্গীতে তাঁর অনেক অনেক অবদান থাকা সত্বেও, তিনি অনেকটাই অপ্রকাশিত থেকে গেছেন। এতো এতো জনপ্রিয়-কালজয়ী, ভালো গানের গীতিকার-সুরকার হয়েও ছিলেন, নিরংহকারী সরল-সহজ, উদার মনের মানুষ।
এমন একজন সৃজনশীল সঙ্গীতজ্ঞ, একবারও জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি পর্যন্ত পাননি। আমাদের সঙ্গীতজগতের এই মহিরূহ ব্যক্তিত্বকে, এ পর্যন্ত কোনো রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত করা হয়নি।
হে সঙ্গীতের মহান কারিগর আপনার গানের মূর্ছনায় আজও আমাদের হৃদয় বিমোহিত হয়, উদ্বেলিত হয়। আপনার সৃষ্ট গান শুনে শুনে ভালো লাগায়-ভালোবাসায় আজও ভরে ওঠে আমাদের মন-প্রাণ। আমাদের অভিবাদন-ভালোবাসা-শ্রদ্ধাঞ্জলিই হোক, আপনার প্রাপ্ত সম্মান-পুরস্কার। কুটি মনসুর অনন্তলোকে ভালো থাকুন এই প্রার্থণা করি।