দেখো এদেশের ইন্ডাস্ট্রি কাদের হাতে গড়া? কারা ভিত করে দিয়ে গেলো অথচ দেখো তাদের বছরান্তেও আমরা একবার স্মরণ করি না। আজকে যখন শুনি এখানে মেধা নাই তখন খুব খারাপ লাগে। খারাপ লাগে এজন্য যে ইন্ডাস্ট্রির মানুষগুলো এহতেশাম-মুস্তাফিজ, খান আতা, জহির রায়হান, মহিউদ্দিন সাহেব, নাজির আহমেদ, ফতেহ লোহানী, শুভাষ দত্ত, সমর দাস, রবীন ঘোষ, সত্য সাহা, সাধন রায়, কিউ জামান, এম এ সামাদ রহমান, খলিলউল্লাহ খান, শওকত আকবর, আনোয়ার হোসেন, গোলাম মুস্তফা, রোজী, সুমিতা দি’র মতো নির্মাতা-কলাকুশলীদের মনে করে না। তাদের নিয়ে চর্চা হয় না। অথচ তারা লাহোর-করাচি, বোম্বে (মুম্বাই), টলিউডের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করেছেন। ইন্ডাস্ট্রিকে দু-হাত ভরে দিয়েছেন। এখনকার প্রজন্মরা তাদের মতো মানুষদের ভুলে গেছে। তাই আমার মতো সামান্য একজন অভিনেত্রীর জন্মদিন মনে করে কিইবা আসে যায়?
ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী উপমহাদেশের কিংবদন্তী অভিনেত্রীর জন্মদিন স্মরণ করিয়ে দিলে এভাবেই ক্ষোভ উগড়ে দিলেন।
জন্মদিনে তাই বিষাদপূর্ণ আম্মাজানখ্যাত এই কিংবদন্তীর। করোনায় দীর্ঘদিন অভিনয় থেকে দূরে থাকলেও লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশন এখনও শোনেন। খোঁজ-খবর রাখেন উপমহাদেশীয় চলচ্চিত্রের। ভালো খবরে যেমন চোখেমুখে ঝিলিক দেয় তেমনি খারাপ খবরে আহত হন।
যেমন করোনা প্রকোপে একের পর এক প্রিয়জনদের চলে যাবার সংবাদে তার হৃদয় বিষাদগ্রস্থ। এমনিতেই নিজের জন্মদিন পালন করেন না তারপরও তাকে মনে করিয়ে দিলে অস্ফূটকন্ঠে বলে উঠলেন কি হবে এসব মনে করে? এসব মনে পড়লে নিজের ঘনিষ্ঠজনদের চলে যাবার দুঃস্বহ বেদনায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে আসে। এই দ্যাখো তুমি বলছো আমার জন্মদিনের কথা অথচ সকালেই জানতে পারলাম আমার পরিবারের খুব কাছের একজন বিখ্যাত ভাষাসৈনিক ও চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর ভাই নাই। তার সঙ্গে রবিন ঘোষের খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো। তখন পাকিস্তানে আমরা ‘কারওয়া’ ছবিটি করছিলাম। তিনিও পাকিস্তানে ছিলেন। রাতদিন সে কি আড্ডা। পাকিস্তান কাজ করতে অনেকদিন সেখানে থেকেছি কিন্তু মুর্তজা ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কটা ঠিক আগের মতোই ছিলো।
ভাষাসৈনিক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী ভাই মারা গেছেন জানতাম না। যখন শুনলাম স্তব্দ হয়ে গেলাম। তিনিও করোনায় মারা গেলেন। রবিন লোহানী ভাই খুব বন্ধু ছিলেন। সংষ্কৃতির বিকাশে তার ভূমিকা এদেশে অনস্বীকার্য।
পরপর মারা গেলেন খ্যাতিমান প্লেব্যাক সিঙ্গার এন্ড্রু কিশোর-বিখ্যাত সংগীথ পরিচালক আলাউদ্দিন আলী। এদেও মধ্যে আলাউদ্দিনের সঙ্গে প্রায়ই ফোনে কথা হতো। তুমি কি বলতে পারো তাদের মতো করে আবার কেউ আমাদের বিনোদিত করবে বা পারবে? শুনেছি তাদের মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় আয়োজন নেই, সহকর্মীরা ভাবলেশহীন জড়। অথচ তাদের এ জাতিকে ঋণী করে গেছেন। তাদের মতোই খুব সাধারণভাবে চলে গেছে আমার স্নেহের শাহনাজ রহমতুল্লা। তারমতো কে আর দেশাত্ববোধক গাইবে জানি না। তাদের প্রয়াণে তাদের ঘিরে নেই কোনো আয়োজন। প্রিয়জনদের এভাবে অবহেলার মৃত্যু আমাকে সত্যি স্তব্দ করে দিচ্ছে। লেবাননের বৈরুত আমার স্বপ্নের জায়গা সেখানে যখন বিষ্ফোরণ হলো তখনও আমি আহত হয়েছি। আমার সুযোগ হয়েছিলো সেখানে যাবার। খুব সুন্দর আর পরিপাটি একটি শহর। এক সময় ভেবেছিলাম চলচ্চিত্র থেকে অবসর নিলে এখানে এসে থাকবো। সেই শহরটি আজ ধ্বংস্তুপে পরিণত হয়েছে। কি বিভৎস অবস্থা। এরপরও নিজের জন্মদিনটাকে আর মনে করতে চাই না। তবুও জন্মদিনে সবার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। বিশেষ করে আমাদের মাঝে এখনও দু-চারজন গুণী আছেন যেমন সিনেমাটোগ্রাফার আফজাল চৌধুরী, চিত্রনায়ক হারুন, আজিজুর রহমান, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, সুরকার আলম খান, আজিজুর রহমান বুলি, ফারুক, উজ্জল, সোহেল রানা, কাজী হায়াৎ, নাসিমা খান, খুরশিদ আলম, সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা তাদের সুস্বাস্থ্য কামনা করি। একটু ভালো লাগে যখন শুনি এই ইন্ডাস্ট্রির অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন সামাজিক কর্মকান্ডে আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে বেশ নাম করেছে। এসব মানুষ আর তাদের কাজ আমাদের আশা দেখায়।
দেখো যে ইন্ডাস্ট্রি থেকে আমার যাত্রা। পাকিস্তান থেকে ফিরে ৩/৪ নম্বর ফ্লোরে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ‘সন্ধি’ ছবিতে কাজ করি। সেই স্মৃতিবহ ফ্লোরটি ভেঙে ফেলা হলো। কারো কোনো বিকার নেই অথচ সবাই ব্যস্ত ব্যক্তিগত ফ্যাসাদ নিয়ে। সিনিয়রদের সম্মান নেই। সামনে সালাম দূরে গেলেই সমালোচনা। কি লাভ এসব করে? করোনায় কিভাবে মানুষগুলো মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পন করছে এগুলো কি আমরা দেখছি না? তবে কেন কার স্বার্থে এই ভেদাভেদ? এসব ভালো লাগে না। প্রত্যাশা থাকবে জীবিত থাকতেই যেন আমার আঁতুরঘর বিএফডিসি সোনালী সময়ে ফেরে।
শিল্পী সমিতি খোঁজ-খবর রাখে কিনা জানতে চাইলে শবনম বলেন, মাঝেমধ্যে জায়েদ খান ছেলেটা ফোন দেয়। কেমন আছি কোনো সমস্যা আছে কিনা জানতে চায়। এছাড়া গাজী ভাই, আফজাল ভাই, আবু মুসা দেবু, ববিতা, চম্পা, বদিউল আলম খোকনের সঙ্গে কথা হয় মাঝেমধ্যে।
চলচ্চিত্রে অভিনয় করে শবনম পাকিস্তানে তিনবার জাতীয় পুরস্কার, সর্বাধিক নিগার অ্যাওয়ার্ড, পিটিভি লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট, লাক্স আজীবন সম্মাননা অর্জন করেন। এছাড়াও চলচ্চিত্র নিয়ে পাকিস্তানের বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ে অতিথি হয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন। সবশেষ তিনি করাচি আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে সেখানে নিজের চলচ্চিত্রের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন।
জন্মস্থান বাংলাদেশে ফিরে করেছেন বেশকিছু ছবি। এরমধ্যে সন্ধি, সন্দেহ, কারণ, সহধর্মিণী, শর্ত, যোগাযোগ, জুলি, বশিরা, দিলসহ আরো বেশ কিছু বাংলা ছবি। তবে অজানা কারণে আম্মাজানখ্যাত এই অভিনেত্রী বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা বঞ্চিত। অভিমান আছে কি না জানতে চাইলো বলেন এক জীবনে মানুষ সব পায় না। তারপরও দর্শক এখনও আমাকে মনে রেখেছে এটাই বড়প্রাপ্তি।
সাবস্ক্রাইব
নিরাপদ নিউজ আইডি দিয়ে লগইন করুন
0 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরাতন