এ কে আজাদ: আজিজুর রহমান। চলচ্চিত্র পরিচালক-প্রযোজক। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির আজীবন সদস্য। অসংখ্য বাণিজ্যসফল সামাজিক চলচ্চিত্রের সফল নির্মাতা, একজন জনপ্রিয়-জননন্দিত ও বরেণ্য চলচ্চিত্রকার। মেধাবী সৃজনশীল এই পরিচালক, সামাজিক কাহিনীর সুন্দর সুন্দর সব চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছেন আমাদের। তাঁর নির্মিত প্রায় সকল ছবিই হয়েছে জনপ্রিয় ও দর্শকনন্দিত।
দীর্ঘ চলচ্চিত্রজীবনে তিনি বিভিন্ন ধরণের কাহিনী নিয়ে সুস্থ বিনোদনমূলক ছবি যেমন নির্মাণ করেছেন, তেমনই শিক্ষামূলক ও শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণেও ছিলেন অনন্য কারিগর। এই অসাধারণ মেধাবী ও কুশলী নির্মাতা তাঁর পরিচালিত শিশুতোষচলচ্চিত্র ‘অশিক্ষিত’ ও ‘ছুটির ঘণ্টা’ এই দুইটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে এদেশের সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে কিংবদন্তী হয়ে আছেন। তাঁর অন্যান্য চলচ্চিত্রের জন্যও, সাধারণ সিনেমাদর্শক কর্তৃক ভালোবাসায় সিক্ত হবেন অনন্তকাল।
এই কিংবদন্তী চলচ্চিত্রব্যক্তিত্ব আজিজুর রহমান এর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০২২ সালের ১৪ মার্চ, কানাডার একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। প্রয়াত এই গুণি চলচ্চিত্রকারের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই । তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
আজিজুর রহমান ১৯৩৯ সালের ১০ অক্টোবর, নওগাঁ জেলার সান্তাহার রেলওয়ে জংশন শহরের কলসা সাঁতাহার মহল্লায়, জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রুপচাঁন প্রামানিক। স্থানীয় আহসানুল্লাহ ইনস্টিটিউট থেকে এসএসসি পাস করেন। ঢাকা সিটি কলেজ (নাইট শিফট) থেকে এইচএসসি পাস করার পর, চারুকলা আর্ট ইনস্টিটিউটে, কমার্সিয়াল আর্ট-এ ডিপ্লোমা করেন আজিজুর রহমান।
খ্যাতিমান চিত্রপরিচালক এহতেশাম এর সিনেমা হল ছিল সান্তাহারে। চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহ থাকা চারুশিল্পী আজিজুর রহমান, পরিচিত হন এহতেশাম সাহেবের সাথে শান্তাহারের ‘মিনার সিনেমা হল’-এ।
ঢাকায় তিনি চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্ত’র সাথে ‘এভারগ্রিন পাবলিসিটি’তে চলচ্চিত্রের ব্যানার তৈরি করতেন। থাকতেন বংশালে। একদিন রাজার দেউড়িতে ‘লিও ফিল্মস’র অফিসে যান। এহতেশাম সাহেবকে চলচ্চিত্রে শিল্পনির্দেশনার কাজের আগ্রহের কথা জানান আজিজুর রহমান।
এহতেশাম সাহেব, তাঁকে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দিতে বলেন। আর এভাবেই ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি এহতেশাম ও মুস্তাফিজ এর সাথে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন।
আজিজুর রহমান পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘সাইফুল মুল্ক্ বদিউজ্জামাল’ মুক্তিপায় ১৯৬৭ সালে। ময়মনসিংহের লোককথা নিয়ে, আশরাফ সিদ্দিকীর গল্প অবলম্বনে ছবিটি তিনি বাংলা ও উর্দু, দুই ভাষাতেই নির্মাণ করেন। উর্দু ভাষায় ছবিটির নাম ছিল ‘মেরে আরমান মেরে স্বপ্নে’। এই ছবিতে অভিনয় করেন নায়ক আজিম ও নায়িকা সুজাতা।
তাঁর পরিচালিত অন্যান্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে- মধুমালা, সমাধান, শাপমুক্তি, অতিথি, পরিচয়, অমর প্রেম, কুয়াশা, অগ্নিশিখা, অনুভব, তাল বেতাল, অশিক্ষিত, মাটির ঘর, ছুটির ঘণ্টা, মহানগর, সোনার তরী, যন্তর মন্তর, জনতা এক্সপ্রেস, অপরাধ, গরমিল, স্বীকৃতি, মায়ের আচঁল, কুচবরন কন্যা, সাম্পানওয়ালা, অভিমান, মেহমান, অহংকার, ফুলেশ্বরী, সোনাই বন্ধু, রঙিন রূপবান, রঙিন কাঞ্চনমালা, আলীবাবা ৪০ চোর, ঘর ভাঙা সংসার, অমর বন্ধন, জয় বিজয়, ভাই ভাবী, শীশমহল, বাপবেটা ৪২০, জিদ, দিল, লজ্জা, ঘরে ঘরে যুদ্ধ, কথা দাও, ডাক্তার বাড়ী, দুঃখিনী জোহরা, জমিদার বাড়ীর মেয়ে, ইত্যাদি অন্যতম।
বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান মিলিয়ে মোট ৫৪টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন আজিজুর রহমান।
২০১৬ সালে ‘মাটি’ নামে একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এটিই ছিল তাঁর প্রথম কাজ।
মতিন রহমান পরিচালিত ‘লাল কাজল’সহ কয়েকটি চলচ্চিত্র প্রযোজনাও করেছেন আজিজুর রহমান। তিনি চলচ্চিত্রের কাহিনী, সংলাপ, চিত্রনাট্যও লিখতেন।
ব্যক্তিজীবনে আজিজুর রহমান ১৯৭২ সালে, শামীম রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। শামীম রহমান পরে চলচ্চিত্র প্রযোজক হিসাবে কাজ করেছেন । তাদের এক মেয়ে ও এক ছেলে। মেয়ে আলিয়া রহমান বিন্দি একজন অভিনেত্রী, তিনি অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচিত্র পুরস্কারও পেয়েছেন। থাকেন কানাডার টরন্টোতে, রিয়েল স্টেট এজেন্ট হিসাবে কর্মরত।
আজিজুর রহমান এর ছেলে সাইদুর রহমান টয় কানাডা প্রবাসী, ব্যাংকে বিসনেস এডমিনে কমর্রত।
শামীম রহমান কানাডায় ছেলের সাথে থাকেন।
আজিজুর রহমান বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের একজন দিকপাল। সামাজিক কাহিনীর বাণিজ্যিসফল ছবি’র কুশলী নির্মাতা। মেধাবী সৃজনশীল এই পরিচালক, সুন্দর সুন্দর সব চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছেন একের পর এক।
দীর্ঘ চলচ্চিত্রজীবনে নানা ধরণের কাহিনী নিয়ে সুস্থ বিনোদনের সুন্দর ছবি যেমন নির্মাণ করেছেন, তেমনই শিক্ষামূলক ও শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণেও ছিলেন অনন্য কারিগর। তাঁর পরিচালিত শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘অশিক্ষিত’ ও ‘ছুটির ঘণ্টা’ চলচ্চিত্র দুটি বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে এবং সুধীজন কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছে।
পঞ্চাশেরও অধিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করে যিনি এদেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে সমৃদ্ধ করেছেন, চলচ্চিত্রশিল্পের উন্নয়নে অনন্য অবদান রেখেছেন। যিনি ১৯৭৮ সালেই তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রের মাধ্যমে জানিয়েছেন ‘শিক্ষার কোনো বয়স নেই’, লেখাপড়া করা কত জরুরী।
চলচ্চিত্র নির্মাণের সেই অসাধারণ কারিগর আজিজুর রহমান তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে রাষ্ট্রীয় কোনো পদক বা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার তিনি পান-নি। চলচ্চিত্র নির্মাণের এই অসাধারণ কারিগরকে আমরা তাঁর সৃজনশীলকর্মের যথাপোযুক্ত সম্মান স্বীকৃতি দিতে পারিনি। এই অনন্য কীর্তিমান মানুষটিকে জীবিত অবস্থায় রাষ্ট্রীয় কোনো পদক/পুরস্কার/সম্মান দিতে আমরা যথেষ্ট কৃপণতা দেখিয়েছি। মৃত্যুর পরেও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কোনরকমের শোকবাণী দেয়ার/শোক প্রকাশ করার উদারতা দেখাতে পারিনি। এই কীর্তিমান মানুষটিকে জীবিত অবস্থায় রাষ্ট্রীয় কোনো পদক/পুরস্কার/সম্মান না দিতে পারা’টা কী আমাদের জন্য সম্মানজনক ? এই প্রশ্নটা থেকে যায় চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট সকলের মনে।
একজন আজিজুর রহমান, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পে ‘নক্ষত্র’সমান। এই কীর্তিমান দেশবরেণ্য মানুষটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে চির অম্লান হয়ে থাকবেন।