ছোটবেলায় বাবার সঙ্গ খুব একটা পাইনি। আমি যখন স্কুলে যেতাম বাবা তখন ঘুমে। আবার আমি যখন স্কুল শেষে বাসায় ফিরতাম বাবা তখন শুটিংয়ে। আবার আমি যখন ঘুমে বাবা তখন বাড়ি ফিরতেন। আমাদের দেখাশোনা করতেন মা। তা-ই বলে যে বাবার ভালোবাসা ছোটবেলা পায়নি তা কিন্তু না। বাবা একটা দিন রাখতেন আমাদের জন্য। শুক্রবারটা বাবা কাজ করতেন না। এদিন বাবা কাছে ডেকে নিতেন। অনেক কথা বলতেন। আমি যে মন দিয়ে শুনতাম তা নয়। কারণ এর মধ্যে অনেক লোক আসত! তাদের ওপর রাগ উঠত।
কিন্তু বাবা বলতেন, শোনো তারা কাজে এসেছেন। আমি যাব আর কথা বলে চলে আসব। অনেক পরিচালক-প্রযোজক আসতেন। এর শিডিউল লাগবে, ওর এই সমস্যা। এসব সমস্যা শেষ করতে করতে বিকাল। সন্ধ্যা হলে বাসায় কোনো না কোনো উপলক্ষে শুক্রবার পার্টি হতোই। অভিমান হতো বাবার ওপর। বাবাকে একদম ভয় পেতাম না। কারণ বাবাকে কোনোদিন রাগ করতে দেখিনি। মায়ের কাছে শুনতাম বাবার অনেক রাগ। শুনে হাসতাম। বলতাম, ভয় দেখিও না তো মা।
বাবা আমাকে চলচ্চিত্রে নিয়ে এলেন। এবার দেখলাম, বাবার রাগ! শুটিং করতে গিয়ে পান থেকে চুন খসলে বাবার ধমক খেয়ে অনেকেই ভয়ে কাঁপতে দেখেছি। আমি ভয় পাওয়া শুরু করলাম। আবার বাসায় এসে তার মিষ্টি হাসি দেখে ভাবতাম, বাবা কি বাস্তবেও অভিনয় করছেন? না, বাবা আমাদের এতটা ভালোবাসতেন যে কখনো ধমক দেননি। কিন্তু পেশার ক্ষেত্রে তিনি অন্য মানুষ। পরে বুঝতে পারলামÑ ব্যক্তিজীবন আর পেশা দুটি আলাদা বিষয়। দুটিকে বাবা কখনো এক করেননি।
জানেন, আমি মাঝে মাঝে বাবার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। তিনি হাসলে আমার এত ভালো লগত যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। তবে বাবার সঙ্গে আমার মতের অনেক অমিল ছিল। এটা শুটিংয়ের কথা বলছি। শুটিংয়ে বাবা অনেক বকাঝকা করেছেন। চিল্লাচিল্লি করতেন। আমি বলতাম, তুমি যেভাবে বলছ সেটা তোমার যুগের। কিন্তু সময় পাল্টেছে। এখন আমার মতো করে করতে চাই। এ নিয়ে যে কতবার বাবা রাগ করেছেন। বাবা অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। সবাইকে বিশ^াস করতেন। একটা ঘটনা বলি, বাবা একটা ছবি বানালেন। তখন আমি বাবাকে বললাম, শোনো পাইরেসি রোধ করতে হলে কিছু টাকা খরচ করতে হবে। বাবা বললেন, আমি আবদুর রাজ্জাক। আমার ছবি কে পাইরেসি করবে। কিন্তু দুই সপ্তাহের মধ্যে ছবি পাইরেসি হলো। বাবা হতাশ হয়ে বললেন, আমি বুঝতে পারিনি। বাবার কণ্ঠ শুনে আমার কান্না করতে ইচ্ছা করছিল। এত অসহায় কণ্ঠ আমি কোনোদিন শুনিনি।
আজ বাবা নেই। বাবাকে অনেকবার বলেছি- বাবা আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। বাবা হাসতেন। বলতেন, আমি তোমার বাবা। আমাকে তো ভালোবাসতেই হবে। বলে কি যে হাসি দিতেন, যা আমার কানে এখনো বাজে। এ জীবনে আমার কোনো দুঃখ নেই। কারণ আমি রাজ্জাকের সন্তান। এ আমার অনেক বড় গর্ব ও অহঙ্কার। তার মতো মহানায়ক এ দেশে আসেনি, আসবে বলে মনেও হয় না।
সাবস্ক্রাইব
নিরাপদ নিউজ আইডি দিয়ে লগইন করুন
0 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরাতন