English

16 C
Dhaka
বুধবার, জানুয়ারি ১, ২০২৫
- Advertisement -

আব্দুল জব্বার খান: আমাদের এই ভূ’খন্ডে পূর্ণদৈর্ঘ বাংলা সবাক চলচ্চিত্র নির্মাণের পথিকৃৎ

- Advertisements -

এ কে আজাদ: আব্দুল জব্বার খান। যাঁর হাত ধরে আমাদের এই ভূ’খন্ডে বাংলা সবাক পূর্ণদৈর্ঘ চলচ্চিত্রের সূচনা হয়েছিল, উন্মোচিত হয়েছিল চলচ্চিত্র নির্মাণের নতুন এক সম্ভাবনার দিগন্ত। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও আমাদের দেশে চলচ্চিত্র নির্মাণের বীজ বপন করে গেছেন। তাঁর দেখানো পথ ধরেই এদেশে গড়ে উঠছে চলচ্চিত্রশিল্প। যিনি তাঁর মেধা, শ্রম ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রসারিত করে গেছেন চলচ্চিত্র নির্মাণের সুকঠিন পথ। তিনি আমাদের দেশের পূর্ণদৈর্ঘ বাংলা সবাক চলচ্চিত্র নির্মাণের পথিকৃৎ।

এদেশের চলচ্চিত্র নির্মাণের জনক হিসেবে অবিহিত আবদুল জব্বার খান-এর মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি আজ থেকে ৩১ বছর আগে, ১৯৯৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর (২৮ ডিসেম্বর রাত ১২টার পর), ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী এই মানুষটির স্মৃতির তাঁর প্রতি অন্তহীন শ্রদ্ধা জানাই । তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।

আব্দুল জব্বার খান ১৯১৬ সালের ১৬ এপ্রিল, আসামের গোলকগঞ্জের, দফরপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পৌত্রিক নিবাস বিক্রমপুরের লৌহজং থানার উত্তর মসদগাঁও। পিতার নাম হাজী মোহাম্মদ জমশের খান এবং মা মোসামৎ আব্বান খাতুন। আসামের ধুবড়ী এলাকায় তাঁর বাবা পাটের ব্যবসা করতেন। সেখানেই শৈশবে তিনি স্কুলে ভর্তি হন। স্কুলে পড়া অবস্থায় তিনি নিয়মিত মঞ্চনাটক করেছেন। নবম-দশম শ্রেণীতে পড়ার সময়ই নাটকের মূল চরিত্রে অভিনয় করতেন তিনি।

আব্দুল জব্বার খান ১৯৪১ সালে, আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল থেকে ডিপ্লোমা নিয়ে চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকায় স্থায়ীভাবে চলে আসেন। ঢাকায় এসে সংগঠিত করেন ‘কমলাপুর ড্রামাটিক এসোসিয়েশন’। এ সংগঠনের উদ্যোগে তিনি ‘টিপু সুলতান’ ও ‘আলীবর্দী খাঁ’ নাটক মঞ্চায়ন করেন। পরে তিনি- ঈসাখাঁ, প্রতিজ্ঞা, ডাকাত, দেবলা দেবী, সিন্ধু বিজয়, চিরকুমার সভা, মাটির ঘর, বংগবর্গী, মেঘমুক্তি, শক্তির মন্ত্র , মীরকাশিম , কেদার রায়, মাটির মানুষ , মিশরকুমারী ,বাংলার প্রতাপ, পলাশী, বীর রাজা, রাতকানা, বেজায় বগড়, বৃস্টি বাবা সতীতীর্থ, নারী ধর্ম, ছেড়াতাঁর, রাজা রানী’সহ অনেক নাটক রচনা করেন।

তৎকালীন সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যাপারে, পশ্চিম পাকিস্তানের চলচ্চিত্র প্রযোজক এফ. দোসানির নেতিবাচক মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে আবদুল জব্বার খান একটি চলচ্চিত্রটি নির্মাণে উদ্যোগী হন।
১৯৫৩-তে নিজের রচিত ‘ডাকাত’ নাটক অবলম্বনে বাংলাদেশের প্রথম সবাক বাংলা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ এর নির্মাণ কাজে হাত দেন।
১৯৫৪ সালের ৬ আগস্ট আবদুল জব্বার খান ‘মুখ ও মুখোশ’-এর মহরত করেন হোটেল শাহবাগে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ইস্কান্দার মির্জা ছবির মহরতের উদ্বোধন করেন। তিনি দুই বছর ধরে ছবিটির কাজ করেন।
স্থানীয়ভাবে কোন ফিল্ম প্রোডাকশন স্টুডিও না থাকায়, ছবির নেগেটিভ ডেভেলপের জন্য লাহোরে পাঠানো হয়।
লাহোরের শাহনূর স্টুডিওতে ‘মুখ ও মুখোশ’-এর পরিস্ফূটন কাজ সম্পন্ন হয়। ১৯৫৬ সালে ছবির কাজ শেষ হয়- কিন্তু ছবিটি নিয়ে প্রথমে ঢাকায় ফেরার অনুমতি পাননি আবদুল জব্বার খান। তাই ‘মুখ ও মুখোশ’ এর প্রথম প্রদর্শনী হয় লাহোরে।

ঢাকায় ফিরে আসার পর ছবিটির প্রিমিয়ার শো অনুষ্ঠিত হয় রূপমহল প্রেক্ষাগৃহে। ‘মুখ ও মুখোশ’ চলচ্চিত্রটি ঢাকায় মুক্তি পায় ১৯৫৬ সালের ৩ আগষ্ট। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম এবং খুলনায় একযোগে প্রদর্শিত হয়।
আর এর মধ্য দিয়েই উন্মোচিত হয়েছিল এদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণের নতুন এক সম্ভাবনার দিগন্ত।

আব্দুল জব্বার খান পরবর্তিতে আরো যেসব চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন- জোয়ার এলো, নাচঘর, বাঁশরী, কাঁচ কাটা হীরে এবং খেলাঘর অন্যতম।

১৯৭১ সালে আব্দুল জব্বার খান আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়, মুজিবনগর সরকারের চলচ্চিত্র বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করেন।
তিনি ‘পপুলার ষ্টুডিও’র অংশীদার ছিলেন। সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র জুরি বোর্ড, অনুদান কমিটি, সেন্সর বোর্ড, ফিল্মস ইন্সটিটিউট এবং ফিল্ম আর্কাইভে।
তিনি ষাটের দশকে গঠিত পাকিস্তান প্রযোজক সমিতির অন্যতম সংগঠক এবং নেতা ছিলেন।

আব্দুল জব্বার খান চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের জন্য- বাচসাস বিশেষ পুরষ্কার, এফডিসির রজতজয়ন্তী পদক, হীরালাল সেন স্মৃতি সংসদ এবং বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন স্বর্নপদক লাভ করেন। ২০০২ সালে, বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর ‘একুশে পদক’-এ ভূষিত করে।

তাঁর সম্মানার্থে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতিতে তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘আব্দুল জব্বার খান স্মৃতি পাঠাগার’।

যেখানে এ দেশে চলচ্চিত্র নির্মাণের অবকাঠামো থেকে শুরু করে যন্ত্রপাতি, শ্যুটিংফ্লোর, এডিটিং মেশিন কিছুই ছিল না!সেখানে চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দেয়া কঠিনতম দুঃসাহসী কাজই ছিল বটে। সেই দুঃসাহসী কাজটিই, অতি সাহসিকতা ও কৃতিত্বের সাথে সম্পন্ন করেছিলেন আবদুল জব্বার খান।
বহু গুণে গুণান্বিত, অসাধারণ প্রতিভাবান আবদুল জব্বার খান, একাধারে অভিনেতা-চিত্রপরিচলক-প্রযোজক- পরিবেশক-নাট্যকার-চলচ্চিত্রের কাহিনী ও চিত্রনাট্যকার ছিলেন।

আবদুল জব্বার খান ১৯৪১ সালের ১৫ মে, বিয়ে করেন সাজেদা খানকে । তাদের আট সন্তান– ১) জাহানারা হাসান রেবা, ২) ইসমত হায়াৎ খান ইনু- ব্যবসায়ী ছিলেন, ৩) মোজাফফর হায়াৎ খান জুলু (মুখ ও মুখোশ-এর শিশুশিল্পী), ৪) নওশের হায়াৎ খান সুমু, ব্যবসায়ী। ৫) জাহাঙ্গীর হায়াৎ খান রুমু, সংগীতজ্ঞ, ৬) জহির হায়াৎ খান, ব্যবসায়ী। ৭) রুপা ফরহাদ, কণ্ঠশিল্পি ৮) মালা খুররুম, কন্ঠশিল্পি। উনারা সবাই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
আবদুল জব্বার খান এর এমন একটি পরিবার যাঁরা এদেশের চলচ্চিত্র তথা শিল্প-সংস্কৃতিতে ও এদেশের স্বাধীনতায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। রক্তিম সালাম এই পরিবারের সবাইকে।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে আবদুল জব্বার খান একটি কিংবদন্তী নাম। এই নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে- অনন্তকাল।

Notify of
guest
0 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরাতন
সবচেয়ে নতুন Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Advertisements
সর্বশেষ
- Advertisements -
এ বিভাগে আরো দেখুন