অভিনেত্রী রানী সরকারের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০১৮ সালের ৭ জুলাই, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। গুণি অভিনেত্রী প্রয়াত রানী সরকারের স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা এবং তাঁর বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করি।
অভিনেত্রী রানী সরকার (আমিরুন নেসা মেরী) ১৯৩২ সালে, সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ থানার সোনাতলা গ্রামে, জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সোলেমান মোল্লা এবং মাতার নাম আছিয়া খাতুন। তিনি সাতক্ষীরার সোনাতলা গ্রামের ইউপি স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে, খুলনা করোনেশন গার্লস স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করেন।
ছোটবেলা থেকে নাচ-গানের প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ ছিল রানী সরকারের। সেই আগ্রহ থেকেই তিনি তখনকার সময়ে মঞ্চে নাচ-গান করতেন। একসময় তাঁর খালাতো ভাই, সঙ্গীত পরিচালক ও নাট্যকর্মী শেখ মোহিতুল হকের হাত ধরে মঞ্চনাটকে অভিনয় শুরু করেন। পরবর্তিতে আসেন চলচ্চিত্রে। রানী সরকার অভিনীত প্রথম ছবি এ জে কারদার পরিচালিত ‘দূর হ্যায় সুখ কা গাঁও’, যা মুক্তি পায়নি। তাঁর প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি, মহিউদ্দিন পরিচালিত ‘তোমার আমার’ মুক্তি পায় ১৯৬১ সালে।
রানী সরকার অভিনীত অন্যান্য ছবিগুলোর মধ্যে- চান্দা, তালাশ, নতুন সুর, তানহা, কাঁচের দেয়াল, সংগম, সুতরাং, বেহুলা, সাইফুল মূলক বদিউজ্জামাল, আগুন নিয়ে খেলা, অভিশাপ, নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা, আনোয়ারা, বালা, বন্ধন, ইস ধারতি পার, পয়সে, ক্যায়সে কাঁহু, কে তুমি, উত্তরণ, মলুয়া, অরুণ বরুণ কিরণ মালা, নাচঘর, জংলিফুল, যাঁহা বাজে শাহনাই, শীত বসন্ত, মোমের আলো, মহুয়া, যে আগুনে পুড়ি, অন্তরঙ্গ, সমাপ্তি, আঁকা বাঁকা, ছদ্মবেশী, আবার তোরা মানুষ হ, অনুভব, চোখের জলে, লাঠিয়াল, নোলক, স্মাগলার, মৎস্য কুমারী, পথে হলো দেখা, মায়ার সংসার, ভানুমতি, টাকার খেলা, ভাওয়াল সন্ন্যাসী, কাঁচ কাটা হীরে, নাচের পুতুল, তিতাস একটি নদীর নাম, দস্যুরানী, সমাধান, রংবাজ, সূর্য গ্রহণ, আধাঁরে আলো, সূর্যকন্যা, সখী তুমি কার, কলমীলতা, বেলা শেষের গান, দুটি মন দুটি আশা, দুই পয়সার আলতা, রেশমি চুড়ি, দেবদাস, মনাপাগলা, চন্দ্রনাথ, প্রিন্সেস টিনা খান, মিস ললিতা, মৌচোর, দেবর ভাবী, দুলারী, সুখে থাকো, বদলা, শুভদা, স্বামী-স্ত্রী, সেই তুফান, সাহেব, ফেরারি বসন্ত, ঘর ভাঙ্গা ঘর, ঘানি, আয়না, এবাদত, থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার, অবুঝ বউ, কারিগর, একই বৃত্তে, নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ, গ্রাস, খাঁচা, অন্যতম।
তখনকার সময়ে রানী সরকারকে মোটামুটি প্রায় সব ছবিতেই অভিনয় করতে দেখা যেত। দীর্ঘ অভিনয়জীবনে তিনি নানা ধরণের চরিত্রে সফলতার সাথে অভিনয় করে গেছেন। বিশেষ করে আমাদের সামাজিক জীবনে বউ-শাশুড়ি/ ননদ-ভাবী সম্পর্কের চরিত্রগুলোর যে দন্দ্ব, সেসব চরিত্রে অতুলনীয় অভিনয় করতেন। বাস্তবভিত্তিক অভিনয় দক্ষতায়, অভিনীত চরিত্রকে দর্শকদের কাছে জীবন্ত করে তুলতেন। নিজের অভিনয়গুণে জনপ্রিয়তাও পেয়েছেন অনায়াসে। বহু দর্শকপ্রিয় ব্যবসাসফল ছবির গুণি অভিনেত্রী ছিলেন রানী সরকার।
রানী সরকার তাঁর অভিনয়কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার আজীবন সম্মাননা-২০১৬, টেলিভিশন রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ট্রাব) পুরস্কার আজীবন সম্মাননা- ২০১৮।
যে সময়ে এদেশে নারীরা সিনেমার পর্দায় অভিনয়তো দূরের কথা, ঘরের বাইরে যেতে শতবার ভাবতো, সেই সময়ে রানী সরকার মঞ্চ-বেতার-টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের পর্দায় অভিনয় করে গেছেন দাপটের সাথে । এটা তখনকার সময়ে নারী জাগরণে অভাবনীয় অংশগ্রহন বলা যেতে পারে। অভিনয়ের মাধ্যমে নারী জাগরণে অবদান রাখা, এই রাজা বিহীন-রাজ্য বিহীন ‘রানী’ তাঁর জীবনের শেষ বয়সে এসে খুবই দুর্বিষহ জীবন কাটিয়েছেন। চরম দুঃখ-কষ্টে জীবন অতিবাহিত করেছেন। ভাতের অভাবের কষ্ট, চিকিৎসার অভাবের কষ্ট তাঁকে ভিশনভাবে ভুগিয়েছে। চাল কিনলে ডাল কেনা যায় না। ভাত থাকলে তরকারি থাকে না। নুন দিয়ে ভাত খেয়ে নেন কখনো। কোখনো না খেয়েও চলে যায় দিন-এমন অবস্থাও হয়েছে তাঁর।
একসময়ের রূপালী পর্দার জৌলুসময় অভিনেত্রী রানী সরকার, জীবনসায়ন্তে অভাব-ক্লিস্টে এ যেন ‘দুঃখিনীর’ চরিত্রে শেষবারের মতো অভিনয় করে গেলেন ।
জনপ্রিয় প্রতিভাবান একজন অভিনেত্রীর এমন দুর্বিষহ্য প্রস্থান অবশ্যই আমাদের কাম্য নয়।
প্রিয় অভিনেত্রী রানী সরকার অনন্তলোকে ভালো থাকুন, এই আমাদের প্রার্থণা ।