এ কে আজাদ: মাসুম আজিজ। অভিনেতা। নাট্যকার ও নির্মাতা। অসাধারণ প্রতিভাবান ও শক্তিমান একজন অভিনেতা। শিল্প-সংস্কৃতি তথা অভিনয় চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন আজীবন। মঞ্চ, টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্র- সব মাধ্যমেই তিনি অভিনয় করেছেন। তিনি নিয়মিত নাটক রচনা ও পরিচালনা করেছেন।
এছাড়াও একটি চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেন তিনি। অনেক গুণে গুণান্বিত একুশে পদক ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত অভিনয়শিল্পী মাসুম আজিজ এর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০২২ সালের ১৭ অক্টোবর, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর। প্রয়াত এই গুণী অভিনেতার স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
মাসুম আজিজ ১৯৫৩ সালের ২২ অক্টোবর, পাবনা জেলার ফরিদপুর উপজেলার খাগবাড়িয়া গ্রামে, জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আক্তারুজ্জামান একজন পুলিশ কর্মকর্তা, তিনি কবিতাও লিখতেন ছিলেন একজন সাংস্কৃতিকমনা মানুষ। বাবার চাকরির কারণে দেশের নানা অঞ্চলে নানা মানুষের সাথে বেরে উঠা মাসুম আজিজ ছোট বেলায় গান করতেন, তার ইচ্ছে ছিল বড় একজন গায়ক হবার। কিন্তু তিনি হয়ে গেলেন বাংলাদেশের একজন বরেণ্য অভিনেতা ।
মাসুম আজিজের বড় ভাই সাবেক চাকসুর ভিপি, প্রগতিশীল লেখক, কমিউনিস্ট বিপ্লবী বীর মুক্তিযোদ্ধা শামসুজ্জামান হিরা, মেজ ভাই প্রগতিশীল লেখক নাসিমুজ্জামান পান্না ছিলেন যুগ্ম সচিব, ছোট ভাই রতন গাউসুজ্জান একজন মঞ্চ অভিনেতা-গণসঙ্গীত শিল্পী।
তার বোনরাও উচ্চ শিক্ষিত এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক সাহিত্য অঙ্গনের সাথে জড়িত।
মাসুম আজিজ স্বাধীনতার পরে পাবনা জেলার ফরিদপুর উপজেলায় ‘রংচক্র’ নামে একটি সামাজিক সাংস্কৃতিক সাহিত্য সংগঠন গড়ে তোলেন একঝাঁক তরুণদের নিয়ে । গান, নাটক, সাহিত্য কর্ম ও খেলাধুলার মাধ্যমে সমাজ ও সমাজের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে সাম্য সমৃদ্ধ ও সুন্দর সমাজ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করে যান।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে মঞ্চে অভিনয় করে পুরস্কৃত হয়েছিলেন মাসুম আজিজ । একসময় পরিচয় হয় তাঁর নাট্যগুরু মামুনুর রাশীদের সাথে। তাঁর হাত ধরেই থিয়েটারে অভিনয় শুরু করেন মাসুম আজিজ।
তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য মঞ্চনাটকের মধ্য- ইন্সপেক্টর জেনারেল, রাক্ষস-খোক্কস, এই দেশে এই বেশে, আমিনা সুন্দরী, ইঙ্গিত, বিষাদ-সিন্ধু, জলদাস, আপদ এবং ট্রায়াল অব সূর্যসেন অন্যতম।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আপদ গল্পকে নাট্যরূপ দিয়ে নির্দেশনা দেন। তাঁর রচনা ও নির্দেশনায় ঢাকা পদাতিকের প্রযোজনা ‘ট্রায়াল অব সূর্যসেন’। মাসুম আজিজ এর রচনা ও নির্দেশনায় ‘থিয়েটার মঞ্চ’ থেকে মঞ্চে আসে ‘কাঠের গড়া’। নাট্যরচনা-আপদ, ট্রায়াল অব সূর্যসেন, মাদারিকা খেল, টেলিফোন ম্যাজিক, কাঠের গড়া।
১৯৮৫ সালে প্রথম তিনি টিভি নাটকে অভিনয় করেন। তার অভিনীত নাটকের সংখ্যা প্রায় চার শতাধিক।
দুই দিগুণে চার, কদম আলী বয়াতি, ইতুনি, অংকুর, সিঁড়ি, ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’, সাকিন সারিসুরি, কালের আয়না, চন্দ্রবিন্দু, ‘তিন গ্যাদা’সহ অসংখ্য টিভি নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি।
অল্প কিছু চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন মাসুম আজিজ। ২০০৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মমতাজ’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তার চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু হয়। মাসুম আজিজ আরো যেসব চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন- ঘানি, গহিনে শব্দ, গেরিলা, গাড়িওয়ালা, লালচর, ইন্দুবালা, আমরা একটা সিনেমা বানাবো, বস্তির ছেলে কোটিপতি, রূপগাওয়াল, এইতো প্রেম,
ভোলা তো যায় না তারে, রাবেয়া, দানব সন্তান প্রভৃতি।
মাসুম আজিজ সরকারি অনুদানে নির্মিত ‘সনাতন গল্প’ নামে একটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন, ছবিটি মুক্তি পায় ২০১৮ সালে । এই চলচ্চিত্রটি ২০১৯ সালে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব এ শ্রেষ্ঠ সমালোচক ফিপ্রেসিজুরি পুরস্কার লাভ করে।
‘ঘানি’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য ২০০৬ সালে শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে রাইসুল ইসলাম আসাদের সঙ্গে যুগ্মভাবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন মাসুম আজিজ। ২০১০ সালে গহিনে শব্দ চলচ্চিত্রের জন্য অ্যামেরিকার ‘সাইলেন্ট রিভার ফিল্ম ফেস্টিভাল’ এ শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পান।
২০০০ সালে ‘একজন আয়নার লস্কর’ নাটকের জন্য মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার এবং বাচসাস পুরস্কার লাভ করেন। তার নিজের নির্দেশনায় নির্মিত নাটক ‘কদম আলী বয়াতি’র জন্য বাচসাস পুরস্কার পান।
এছাড়া ২০২২ সালে একুশে পদক পেয়েছেন মাসুম আজিজ।
মাসুম আজিজ নিজে গান লিখেছেন এবং সে গানে নিজেই সুর করেছেন । তিনি ‘কর্কশ প্রেসনোট’ নামে একটি গানের অ্যালবামও প্রকাশ করেন । উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ভুপেন হাজারিকার গুণমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন মাসুম আজিজ। ভূপেন হাজারিকার গান গেয়ে তিনি প্রশংসা পেয়েছেন অনেক। সরাসরি ভূপেন হাজারিকার সান্নিধ্যও লাভ করেন তিনি।
ব্যক্তিজীবনে, মাসুম আজিজ এর সহধর্মিণী অভিনেত্রী সাবিয়া জামান। তাদের মেয়ে প্রজ্ঞা আজিজ এবং ছেলে উৎস জামান।
মাসুম আজিজ একাধারে নাট্যকার, মঞ্চ অভিনেতা, টিভি নাটক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা ও একজন কণ্ঠশিল্পী । মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে একজন মেধাবী গুণী অভিনেতা হিসেবে সুপরিচিত । নানা গুণে গুণান্বিত এই মানুষটি সঙ্গীত জগতের লোকদের কাছে বাংলাদেশের ভূপেন হাজারিকা বলে অবিহিত ছিলেন।