আজাদ আবুল কাশেম: শক্তিমান অভিনেতা আবদুল মতিন-এর ৩৪তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ১৯৮৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। প্রয়াত এই গুণি অভিনেতার স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
অভিনেতা আবদুল মতিন ১৯২১ সালের ১৭ জুলাই, পুরান ঢাকার নারিন্দায়, জন্মগ্রহণ করেন । বাবার নাম আবদুর রহমান, মা বিবি সমীরন। তিনি ছিলেন বাবা-মা’য়ের একমাত্র সন্তান।
শৈশব থেকেই আবদুল মতিনের মাথায় অভিনয়ের ভুঁত চেপে বসে। স্কুলে পড়া-লেখা করার সময় থেকেই তিনি মঞ্চনাটকের সাথে জড়িয়ে পরেন। তখনকার সময়ে বিভিন্ন মঞ্চে নানা ধরনের নাটকে অভিনয় করে বেশ নাম-ডাক হয় তাঁর।
ঢাকা বেতার-এ ১৯৪৮ সালে চাকুরিতে যুক্ত হন। বেতারে যুক্ত ছিলেন- ঘোষক, নাট্য প্রযোজক, নাট্যকার ও সংগীত রচয়িতা হিসাবে । ১৯৬২ সালের ১ জুলাই, সিলেট বেতার কেন্দ্রের উদ্বোধনী দিন থেকে অনুষ্ঠান প্রধান হিসাবে যোগ দেন তিনি ।
জানা যায় যে, বেতারের চাকুরিকালে ১৯৫২’র ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের মিছিলে গুলিবর্ষনের প্রতিবাদে ও শহীদদের সম্মানে বেতারে হরতাল পালন করা হয়, আর এই হরতাল পলনকারীদের আহবায়ক ছিলেন আবদুল মতিন।
এছাড়াও হরতালের পর ২৪ ফেব্রুয়ারি বেতারে যোগদানের দিন প্রোগ্রাম সীটে (লগবুকে) পুরো অনুষ্ঠান সিডিউল বাংলায় লিখেছিলেন তিনি। উল্লেখ্য তখন সরকারি সব ফাইলপত্র ইংরেজীতে লিখতে হতো।
১৯৫৬ সালে আমেরিকার মেট্রোগোল্ডেন মায়া (এমজিএম) প্রযোজনা সংস্থার, ঢাকায় নির্মিত প্রথম ডকুমেন্টরী ছবিতে অভিনয় করেন ও সহকারী হিসেবে কাজ করেন আবদুল মতিন।
১৯৬০ সালে উদয়ন চৌধুরী পরিচালিত ‘বিষকন্যা’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন আবদুল মতিন। যদিও ছবিটি মুক্তিপায়নি।
তাঁর অভিনীত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হচ্ছে- কাচেঁর দেয়াল, সুতরাং, কাজল, সাতরং, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, আলীবাবা, আনোয়ারা, দুই ভাই, মালা, মেহেরবান, এক জালিম এক হাসিনা, সংসার, অরুণ বরুন কিরণমালা, ছদ্মবেশী, তিতাস একটি নদীর নাম, মধুমিলন, আদর্শ ছাপাখানা, কাঁচকাটা হীরে, স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা, সেতু, রংবাজ, অরুণোদয়ের অগ্নিস্বাক্ষী, অনির্বাণ, খেলাঘর, বাংলার মুখ, ফকির মজনু শাহ, লালন ফকির, অনেক দিন আগে, কুয়াশা, মিশর কুমারী, দ্বীপ নিভে নাই, শপথ নিলাম, ঈশা খাঁ, উৎসর্গ, মালকাবানু, এখানে আকাশ নীল, আলোর মিছিল, অশ্রু দিয়ে লেখা, লাঠিয়াল, অবাক পৃথিবী, শনিবারের চিঠি, টাকার খেলা, জিঘাংসা, জয় পরাজয়, দাতা হাতেম তাই, চাষীর মেয়ে, আসামী, অনুভব, অনুরাগ, নাতবৌ, পাগলা রাজা, ধন্যিমেয়ে, সারেং বৌ, অলংকার, দূটি মন দুটি আশা, মাস্তান, অঙ্গার, অনুভব, কাজল রেখা, চম্পা চামেলি, লালু ভুলু, বড় ভালোলোক ছিল, লাল সবুজের পালা, ভালো মানুষ, সুখে থাকো, প্রতিহিংসা, চোর, বড় মা, অভিযান, মৌচোর, সুলতানা ডাকু, মধুমালতী, উজানভাটি, শাস্তি, ঘরে বাইরে, সৎভাই, সাহেব, জেলের মেয়ে, ইত্যাদি।
টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকেই অভিনয় করে আসছেন আবদুল মতিন। টেলিভিশনে প্রচুর নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি । সকাল সন্ধ্যা, আনোয়ারা, শুকতারা, মুড়ির মোয়া, ঘোড়ার গাড়ী’সহ অনেক জনপ্রিয় নাটকে অভিনয় করেন তিনি। কিছু নাটকে কেন্দ্রীয় চরিত্রেরও অভিনয় করেছেন।
সকাল সন্ধ্যা- ধারাবাহিক নাটকে ‘পরাণ ভাই’ চরিত্রে অভিনয় করে সেসময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলেন তিনি।
৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও স্বাধীনতা আন্দোলনে বিক্ষুব্দ শিল্পী সমাজের যুগ্ম মহাসচিব ছিলেন আবদুল মতিন।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সকালে মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর নেতৃত্বে অচলপ্রায় ঢাকা বেতারকে সচল করে অনুষ্ঠান ঘোষণা ও প্রচার করেন তিনি।
আবদুল মতিন ছিলেন টেলিভিশন নাট্যশিল্পী ও নাট্যকার সংসদ (টেনাশিনাস)-এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ।
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও সমিতির গঠনতন্ত্রের রচয়িতাদের অন্যতম একজন ছিলেন তিনি ।
ব্যাক্তিগতজীবনে আবদুল মতিন, আয়শা খাতুনের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন । তাদের ১৫ জন ছেলে-মেয়ে।
তাঁর এক ছেলে আবদুর রাতিন ছিলেন বিশিষ্ট অভিনেতা। আরেক ছেলে অনজন রহমান একজন সাংস্কৃতিকর্মী ও সাংবাদিক।
মঞ্চ, বেতার, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের শক্তিমান অভিনেতা ছিলেন আবদুল মতিন। খলচরিত্রে তাঁর সাবলিল অভিনয় পার্দর্শিতা ছিল খুবই অনবদ্য। পর্দায় অতি খারাব মানুষের চরিত্রে অভিনয় দক্ষতায়, জাতশিল্পী হিসেবে তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন অনায়াসে।
ঐতিহাসিক ছবি নবাব সিরাজউদ্দৌলাতে, সিরাজউদ্দৌলার ঘাতক ‘মোহম্মদী বেগ’ চরিত্রে অভিনয় করে আজও তিনি দর্শক হদয়ে অমর হয়ে আছেন।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র তথা শিল্প-সংস্কৃতিতে আবদুল মতিনের অবদান অবশ্য অবশ্যই স্মরণযোগ্য।