আজাদ আবুল কাশেম: আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদ, ভাষাসৈনিক, সুরকার-সঙ্গীত পরিচালক আলতাফ মাহমুদ। যিনি আজকের এই দিনে, ৩০ আগস্ট ১৯৭১ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য শহীদ হন। মাত্র ৩৮ বছর বয়সে এই অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা, দেশমাতৃকাকে ভালোবেসে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করেন । এই গুণি সঙ্গীতজ্ঞের প্রতি সংগ্রামী সালাম ও গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
শহীদ আলতাফ মাহমুদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
আলতাফ মাহমুদ (এ.এন.এম আলতাফ আলী) ১৯৩৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর, বরিশাল জেলার মুলাদী উপজেলার পাতারচর গ্রামে, জন্মগ্রহন করেন। তাঁর বাবার নাম নিজাম আলী। ১৯৪৮ সালে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করে, বিএম কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। পরে তিনি ক্যালকাটা আর্টস স্কুলে গিয়ে ভর্তি হন।
শৈশব থেকেই গানের প্রতি আলতাফ মাহমুদের অনুরাগ প্রকাশ পায়। বরিশাল জেলা স্কুলে পড়াকালীনই তাঁর সঙ্গীতচর্চা শুরু হয়। বিখ্যাত বেহালাবাদক সুরেন রায়ের নিকট তিনি সঙ্গীতের তালিম নেন। দরাজ গলায় মধুর সুরে নিজ বাড়ির সামনে বেঞ্চিতে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা গান গাইতেন। তাঁর গানে মুগ্ধ হত পরিবারের লোকজন ও সহপাঠীরা থেকে শুরু করে স্কুলের শিক্ষকরাও। নিজে গান লিখতেন, সুরও করতেন। বিভিন্ন জলসা-অনুষ্ঠানে গান গেয়ে তিনি প্রশংসাও পান।
আঁকা-আঁকিতেও দারুন হাত ছিল তাঁর। ছবি আঁকা ছিল তাঁর আরেক নেশা। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বিভিন্ন আন্দোলনে- সংগ্রামে তাঁকে দেখা গেছে প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন, ব্যানার আঁকতে।
হারমোনিয়াম, তবলা, বেহালা, পিয়ানো, বাঁশি, প্রায় সবরকম বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন তিনি। ষাটের দশকে এসে অর্কেস্টেশন সম্পর্কে বিরল জ্ঞান অর্জন করেন। সেই সময়ে উপমহাদেশের অল্প যে কয়জন সংগীতজ্ঞ এ সম্পর্কে জ্ঞান রাখতেন তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।
আলতাফ মাহমুদ ১৯৫০ সালে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় এসে ‘ধুমকেতু শিল্পী সংঘ’-এ যোগ দেন।
১৯৫২ সালে তিনি ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন। ভাষা আন্দোলনে গণজাগরণের লক্ষ্যে বহু গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি…, ভাষা-শহীদদের উদ্দেশ্যে আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত এই সুবিখ্যাত গানটি বর্তমানে যে সুরে গাওয়া হয়, তা আলতাফ মাহমুদের করা।
১৯৫৪ সালে ভিয়েনা শান্তি সম্মেলন-এ আমন্ত্রিত হয়ে তিনি করাচি পর্যন্ত গিয়েছিলেন, তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাঁর পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করায় সম্মেলনে যোগ দিতে পারেননি। ১৯৫৬ সালে আলতাফ মাহমুদ করাচি বেতারে প্রথম সঙ্গীত পরিবেশন করেন। ‘ইত্তেহাদে ম্যুসিকি’ নামে দশ মিনিটের একটি অনুষ্ঠান প্রযোজনা ও পরিচালনা করতেন তিনি। আলতাফ মাহমুদ ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত করাচিতেই ছিলেন। সেখানে ওস্তাদ আব্দুল কাদের খাঁর কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বিষয়ে তালিম নিয়েছেন।
সঙ্গীতপরিচালক দেবু ভট্টাচার্যের সহকারী হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত হন।
আলতাফ মাহমুদের সুর ও সঙ্গীতে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম ছবি ‘তানহা’। বেবী ইসলাম পরিচালিত ছবিটি মুক্তিপায় ১৯৬৪ সালে। তাঁর সুর ও সঙ্গীত পরিচালিত অন্যান্য ছবিসমূহ- বেহুলা, কার বউ, রহিম বাদশা ও রূপবান, আগুন নিয়ে খেলা, আপন দুলাল, ক্যায়সে কাহু, নয়ন তারা, আনোয়ারা, দুইভাই, আঁকাবাঁকা, সংসার, আদর্শ ছাপাখানা, সুয়োরাণী দুয়োরাণী, সপ্তডিঙ্গা, ক খ গ ঘ ঙ, মিশর কুমারী, কুচবরণ কন্যা, প্রতিশোধ, অবুঝ মন, প্রভৃতি।
তাঁর সুর করা ভাষা শহীদদের জন্য লেখা জগত বিখ্যাত গান- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি.., জহির রায়হান পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে।
আলতাফ মাহমুদ কন্ঠশিল্পী হিসেবে গান গেয়েছেন- তানহা, বাঁশরী, সুয়োরাণী দুয়োরাণী, ক খ গ ঘ ঙ ও কুচবরণ কন্যা ছবিতে। আঁকাবাঁকা ও ক খ গ ঘ ঙ এই দুটি ছবিতে অভিনয়ও করেছেন তিনি।
১৯৭৭ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন আলতাফ মাহমুদ। ২০০৪ সালে পান স্বাধীনতা পুরস্কার।
তাঁকে চির স্মরণীয় করে রাখার জন্য, ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘শহীদ আলতাফ মাহমুদ ফাউন্ডেশন’। সম্পূর্ণ পারিবারিক ও ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে এই ফাউন্ডেশন পরিচালিত হয়।
প্রতিবছর স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য দুইজন গুণীব্যক্তিকে এই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সম্মাননা দেওয়া হয়।
একজন সুরপাগল, দেশপ্রেমিক, ভাষাসৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ আলতাফ মাহমুদ। যাঁদের মেধায়, শ্রমে, ঘামে সমৃদ্ধ হয়েছে আমাদের সঙ্গীত মাধ্যম, তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর উপস্থিতিতে সমৃদ্ধ হয়েছে আমাদের চলচ্চিত্রের সঙ্গীতও। যাঁদের সাহসিকতায়, যাঁদের আত্মদানে স্বাধীন হয়েছে আমাদের মাতৃভূমি, তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম একজন। প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন আমাদের গণসঙ্গীতকেও। মহান ভাষা আন্দোলনে, মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অংশগ্রহণ আমরা গর্বভরে উচ্চারণ করতে পারি।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি-‘ অমর এই গানের সুরস্রষ্টাও তিনি।
১৯৭১-এ আলতাফ মাহমুদ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং তাঁর বাসায় অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গোপন ক্যাম্প স্থাপন করেন। কিন্তু ক্যাম্পের কথা ফাঁস হয়ে গেলে পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে আটক করে, বাসা থেকে চোখ বাঁধা অবস্থায় নিয়ে যায়। তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হলেও তিনি মুখ খোলেননি, নতী স্বীকার করনেনি। পাকিস্তানি জান্তাদের পৈশাচিক নির্যাতনের পরেও হার না মানা, এই অকুতোভয় বীর একসময় প্রাণ হারান, শহীদ হন ।
মহান ভাষা আন্দোলন থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধ, প্রগতিশীল রাজনীতি থেকে সাংস্কৃতিক আন্দোলন- সর্বত্রই শহীদ আলতাফ মাহমুদের সক্রিয় উপস্থিতি, দেশের স্বাধীনাতার জন্য তাঁর আত্মদান, তাঁকে করে রেখেছে চির অমর।