English

15 C
Dhaka
রবিবার, ডিসেম্বর ২২, ২০২৪
- Advertisement -

বহুমাত্রিক প্রতিভায় সমৃদ্ধ সৃজনশীল মানুষ ফতেহ লোহানীর মৃত্যুবার্ষিকী আজ

- Advertisements -

এ কে আজাদ: ফতেহ লোহানী। অভিনেতা, লেখক-সাংবাদিক, চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিচালক, চিত্রনাট্যকার ও গীতিকার। একজন নাট্যকার, অনুবাদক ও আবৃত্তিকার হিসেবেও ছিলেন সুপরিচিত। এফডিসি প্রতিষ্ঠার পর, এ শিল্পের ভিত রচনায় ও চলচ্চিত্রশিল্পকে গড়ে তোলার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে যে ক’জন চলচ্চিত্রব্যক্তিত্ব কাজ করে গেছেন, ফতেহ লোহানী ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন।

তিনি অভিনেতা হিসেবেও ছিলেন খ্যাতিমান। ছিলেন প্রগতিশীল ও আধুনিক চিন্তা-চেতনার এক মহিরূহ চলচ্চিত্রব্যক্তিত্ব। বহুমাত্রিক প্রতিভায় সমৃদ্ধ এই সৃজনশীল মানুষটির মৃত্যুবার্ষিকী আজ । তিনি ১৯৭৫ সালের ১২ এপ্রিল, চট্টগ্রামে ‘কুয়াশা’ ছবির শ্যুটিং-এর সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৫ বছর। প্রয়াত এই গুণিব্যক্তিত্বের স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।

ফতেহ লোহানী (আবু নজীর মোহাম্মদ ফতেহ আলী খান লোহানী) ১৯২০ সালের ৭ মে, সিরাজগঞ্জ জেলায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আবু সাঈদ মোহাম্মদ সিদ্দিক হোসেন খাঁ (১৮৯২-১৯২৯) যিনি আবু লোহানী নামে অধিক পরিচিত একজন সাংবাদিক ও সাহিত্যিক, তৎকালীন কলকাতার বিখ্যাত ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘দ্য মুসলমান’-এর সহকারী সম্পাদক ছিলেন এবং মাতা ফাতেমা লোহানী কলকাতা করপোরেশন স্কুলের শিক্ষিকা ও লেখিকা ছিলেন। ফতেহ লোহানীর ছেলেবেলা ও শিক্ষাজীবন অতিবাহিত হয় কলকাতায়। কলকাতার ‘সেইন্ট মেরিজ ক্যাথেড্রাল মিশন হাই স্কুল’ থেকে মাধ্যমিক, ‘রিপন কলেজ’ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পাস করেন।

কিশোর বয়সেই তিনি কলকাতায় মুকুন্দ দাসের ‘স্বদেশী যাত্রা’ দেখে মুগ্ধ হন এবং অভিনয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কলকাতার স্কুলে পড়াকালীন সময়েই তিনি অভিনয়ের সাথে সম্পৃক্ত হন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মঞ্চে কৌতুকাভিনয় ও আবৃত্তি করতেন তিনি। কলেজে পড়ার সময় বেশকিছু বাংলা ও ইংরেজি মঞ্চনাটকে অভিনয় করেন ফতেহ লোহানী। কলেজে অভিনীত তাঁর প্রথম নাটক বনফুল রচিত ‘শ্রী মধুসূদন’। এই নাটকে তিনি মধুসূদনের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। সেসময় তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ উৎপল দত্ত পরিচালিত- ‘হ্যামলেট’ নাটকে, হ্যামলেটের পিতার ভুতের ভূমিকায় অভিনয় করা। পরবর্তীতে তিনি ‘শৌখিন নাট্যগোষ্ঠী’ ও ‘সাধারণ রঙ্গমঞ্চে’র সঙ্গে যুক্ত হন। এসময়ে তিনি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকটি পরিচালনা করার পাশাপাশি অভিনয়ও করেন। বাণী থিয়েটার মঞ্চে ‘রামের সুমতি’ নাটকে ‘কিশোর রামের’ চরিত্রে অভিনয় করেন। এসময়ে পেশাদার নাট্যগোষ্ঠী ‘আলোক তীর্থ’র উদ্যোগে ‘রঙমহল’-এ মঞ্চস্থ হেমেন রায়ের ‘নর-নারী’ নাটকে তাঁর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে, প্রখ্যাত চিত্রগ্রাহক ও চলচ্চিত্রকার বিমল রায়, ফতেহ লোহানীকে হিন্দি চলচ্চিত্র ‘হামরাহী’তে একটি ছোট চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ করে দেন। ১৯৪৫ সালে, মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিতে তিনি ‘কিরণ কুমার’ নামে অভিনয় করেন। ১৯৪৬ সালে, হিমাদ্রি চৌধুরী (ওবায়েদ-উল হক) প্রযোজিত ও পরিচালিত ‘দুঃখে যাদের জীবন গড়া’ চলচ্চিত্রে প্রতিনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি।

কলকাতায় থাকাকালীনই ফতেহ লোহানী সাংবাদিকতা ও সাহিত্য চর্চায় যুক্ত হন। সেই সাথে বেতারেও। ঢাকা বেতারে বাংলা নিউজ রিডার হিসাবে যোগ দিতে ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট, বেতারে প্রথম পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা খবর পড়েন তিনি। কিছুদিন ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার সাব-এডিটর এবং ‘সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ’ পত্রিকার সিনেমা সম্পাদক হিসেবে ছিলেন। এছাড়াও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লিখতেন গল্প ও প্রবন্ধ। নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ‘অগত্যা’ নামে একটি মাসিক সাহিত্য ম্যাগাজিন।

বেতারের চাকরী ছেড়ে ১৯৫০ সালে তিনি লন্ডনে চলে যান। লন্ডনে গিয়ে নাজির আহমেদের সহযোগিতায় বিবিসি বাংলা বিভাগের প্রোগ্রাম প্রযোজক হিসেবে চাকরি নেন। ফতেহ লোহানী লন্ডনে ‘ওল্ডভিক থিয়েটার স্কুলে’ নাট্য প্রযোজনা বিষয়ে দুই বছরের কোর্স সম্পন্ন করেন ও ‘লন্ডন প্যাডেলিয়ান’ নামে একটি পেশাদার নাট্যমঞ্চে যোগদেন। ব্রিটিশ মুভিটোনে যে সব বাংলা ডকুমেন্টারী হতো, সেগুলোতে কমেন্ট্রি দিতেন তিনি।

লন্ডন থেকে ১৯৫৬ সালে দেশে ফিরে আসেন ফতেহ লোহানী। ১৯৫৭ সালে এফডিসি প্রতিষ্ঠিত হলে, চলচ্চিত্রশিল্পকে সুদৃঢ়ভাবে গড়ে তোলার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে (নাজির আহমেদ, মোহাম্মদ শামীম এবং ধীরেন্দ্র সাহার সহযোগিতায়) ‘আসিয়া’ এবং ‘মাটির পাহাড়’ নামে দুটি চলচ্চিত্র পরিচালনা শুরু করেন। মাটির পাহাড় (১৯৫৯), আসিয়া (১৯৬১), সাতরঙ (১৯৬৫) নামে এই ৩টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন ফতেহ লোহানী ।

ঢাকাই চলচ্চিত্রে অভিনেতা হিসেবে ফতেহ লোহানীর অভিষেক ঘটে ১৯৬৪ সালে জিল্লুর রহিম পরিচালিত ‘এই তো জীবন’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে। তাঁর অভিনীত অন্যান্য ছবিগুলো হলো- রাজা এলো শহরে, মহুয়া, আপন দুলাল, দুই ভাই, পরশমণি, মলুয়া, এক জালিম এক হাসিনা, তানহা, সাতরঙ, বেহুলা, ফির মিলেঙ্গে হাম দোনো, আগুন নিয়ে খেলা, দরশন, জুলেখা, এতটুকু আশা, বাল্যবন্ধু, মোমের আলো, মায়ার সংসার, মিশর কুমারী, পিতাপুত্র, আদর্শ ছাপাখানা, তানসেন, আঁকাবাঁকা, অন্তরালে, অন্তরঙ্গ, ঘূর্ণিঝড়, অচেনা অতিথি, শ্রীমতি ৪২০, দিনের পর দিন, স্বরলিপি, দর্পচূর্ণ, দীপ নেভে নাই, রাঙ্গা বউ, মাসুদ রানা, জিঘাংসা, অনেক প্রেম অনেক জ্বালা, আলো তুমি আলেয়া, ডাকু মনসুর, দুই রাজকুমার, অপবাদ, নিশান, একমুঠো ভাত, কুয়াশা, ইত্যাদি।
চলচ্চিত্র ছাড়াও ফতেহ লোহানী, বেতার ও টেলিভিশন নাটকেও অভিনয় করেছেন। তিনি নাটক রচনাও করেছেন। তাঁর রচিত কয়েকটি নাটক হচ্ছে- নিভৃত সংলাপ, দূর থেকে কাছে, সাগরদোলা প্রভৃতি।

একজন দক্ষ আবৃত্তিশিল্পী হিসেবেও তিনি ছিলেন প্রশংসিত। সাহিত্য শাখায় তিনি একজন গল্পকার ও অনুবাদক হিসেবেও সুপরিচিত ছিলেন। মাসিক মোহাম্মদী, সওগাত প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর উল্লেখযোগ্য ক’টি গল্প প্রকাশিত হয়। ফতেহ লোহানী অনূদিত নাটকসমূহ হচ্ছে- একটি সামান্য মৃত্যু (আর্থার মিলারের ডেথ অব এ সেলসম্যান), চিরন্তন হাসি (ইউজিন ও নীলের ল্যাজারাস লাফড), বিলাপে বিলীন (ইউজিন ও নীলের মর্নিং বিকামস ইলেক্ট্রা)। তাঁর অনূদিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, মার্কিন লেখক হেমিংওয়ের Old man and the Sea-এর বাংলা অনুবাদ উপন্যাস ‘সমুদ্রসম্ভোগ’।

কর্মজীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ ফতেহ লোহানী অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। যার মধ্যে, ১৯৬১ সালে, শ্রেষ্ঠ বাংলা চলচ্চিত্র হিসেবে ‘আসিয়া’ ছবির জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পুরস্কার, পাকিস্তানের নিগার পুরস্কার, ১৯৬৮ সালে, শ্রেষ্ঠ বেতার নাট্য-অভিনেতা হিসেবে পাকিস্তানের ‘মজিদ আলমাক্কী’ পুরস্কার, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস) পুরস্কার এবং এফডিসি-র রজত জয়ন্তী পুরস্কার (১৯৮৩) উল্লেখযোগ্য।

ফতেহ লোহানী ব্যক্তিজীবনে রিজিয়া লোহানীকে বিয়ে করেন। রিজিয়া লোহানী ‘ইডেন মহিলা কলেজ’-এর অধ্যাপক ছিলেন। তাদের একমাত্র মেয়ে, সুমনা লোহানী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে কর্মরত রয়েছেন৷

বহুমাত্রিক প্রতিভায় সমৃদ্ধ ফতেহ লোহানী ছিলেন একাধারে- অভিনেতা, চিত্রনাট্যকার, সংলাপ লেখক, গীতিকার, বেতারের অনুষ্ঠান প্রযোজক, লেখক-সাংবাদিক, সংবাদ পাঠক, নাট্যকার, আবৃত্তিকার ও অনুবাদক। একজন প্রতিভাবান, সৃজনশীল মেধাবী মানুষ হিসেবে, শিল্পের নানা শাখায় বিচরণ করেছিলেন তিনি। একজন উচুমানের অভিনেতা হিসেবে তিনি ছিলেন, প্রসংশিত, প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয়। কখনো নায়ক, কখনো ভিলেন, কখনো রাজা-জমিদার, আবার কখনো নিরিহ ভালো মানুষ- যখন যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন, একজন জাতঅভিনেতার স্বাক্ষর রেখেছেন, অনবদ্য সৃজনশীল অভিনয়ের মাধ্যমে। একজন শক্তিমান দাপুটে অভিনেতা হিসেবে চলচ্চিত্রে তাঁর আবস্থান ছিল সর্বোচ্চ শীর্ষে।

চলচ্চিত্র নির্মাণ করেও ব্যাপক আলোচিত ও প্রসংশিত হয়েছেন ফতেহ লোহানী। চলচ্চিত্র পরিচালনাতেও তিনি, তাঁর মেধা মননশক্তি দিয়ে সৃজনশীল কাজ করে গেছেন। তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রসমূহ, সে সময়ে চলচ্চিত্রদর্শক ও সমালোচক কর্তৃক সমাদৃত ও প্রসংশিত হয়েছে। চলচ্চিত্র সম্পর্কে বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ ছিলেন তিনি। চলচ্চিত্র সম্পর্কে তাঁর বিদেশে অর্জিত জ্ঞান ও শিক্ষা দিয়ে, নিজের দেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে করে গেছেন সমৃদ্ধ।
অসাধারণ ধী শক্তি সম্পন্ন একজন গুণি মানুষ ছিলেন তিনি। প্রগতিশীল, আধুনিক চিন্তা-চেতনার এক মহিরূহ চলচ্চিত্রব্যক্তিত্ব, ফতেহ লোহানী। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পে তথা শিল্প-সংস্কৃতিতে তাঁর অবদান, ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

Notify of
guest
0 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরাতন
সবচেয়ে নতুন Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Advertisements
সর্বশেষ

আল কোরআন ও আল হাদিস

আজকের রাশিফল

- Advertisements -
এ বিভাগে আরো দেখুন