এ কে আজাদ: লাকী আখন্দ। একজন প্রতিভাদীপ্ত সুরকার, গিটারিস্ট, কন্ঠশিল্পী, গীতিকার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা । আমাদের সঙ্গীত ভুবনের বিস্ময়কর এক প্রতিভা তিনি। এই প্রতিভাবান সঙ্গীতশিল্পীর ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০১৭ সালের ২১ এপ্রিল, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬১ বছর। গুণী এই সঙ্গীতশিল্পীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
লাকী আখন্দ ১৯৫৬ সালের ১৮ জুন, পুরানো ঢাকার আরমানিটোলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক বাড়ি কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার উপজেলার ফতেহাবাদ ইউনিয়নের খলিলপুর গ্রামে। পিতা আব্দুল হক আখন্দ জনসংযোগ অধিদপ্তরের উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা ছিলেন, মা নূরজাহান বেগম। মাত্র ৫ বছর বয়সেই বাবার কাছ থেকে সংগীতে হাতেখড়ি হয় তাঁর। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত টেলিভিশন এবং রেডিওতে শিশুশিল্পী হিসেবে সংগীত বিষয়ক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন তিনি।
মাত্র ১৪ বছর বয়সেই এইচএমভি পাকিস্তানের সুরকার এবং ১৬ বছর বয়সে এইচএমভি ভারতের সংগীত পরিচালক হিসেবে নিজের নাম যুক্ত করেন, এই প্রতিভাবান সংগীতশিল্পী ।
১৯৭১ সালে আমাদের দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে ছিলেন লাকী আখন্দ। মাত্র পনের বছর বয়সে দশম শ্রেনীতে পড়াকালীন সময়ে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতে চলে যান এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে নিয়মিত সঙ্গীত পরিবেশন করেন। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন তিনি, বীর মুক্তিযোদ্ধা।
১৯৭৫ সালে, লাকী আখন্দ তাঁর ছোট ভাই শিল্পী হ্যাপী আখন্দের একটি অ্যালবামের সঙ্গীতায়োজন করেন। এই অ্যালবামটিতেই ছিল, সেই বিখ্যাত গান “আবার এলো যে সন্ধ্যা” ও “কে বাঁশি বাজায়রে”, কণ্ঠ দিয়েছিলেন হ্যাপী আখন্দ।
লাকী আখন্দ ১৯৮০ সালে, সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী পরিচালিত ‘ঘুড্ডি’ চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এই চলচ্চিত্রের কয়েকটি গান ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে সেই সময়ে।
১৯৮৪ সালে, তাঁর প্রথম একক অ্যালবাম ‘লাকী আখন্দ’ প্রকাশিত হয় । এই অ্যালবামটি সেই সময়ে খুব আলোচিত ও জনপ্রিয় হয়। এরপর আরো কিছু অ্যালবাম বের হয় তাঁর, একক বা মিশ্রভাবে। এই অ্যালবামগুলোর মধ্যে আছে- পরিচয় কবে হবে, বিতৃষ্ণা জীবনে আমার,
আনন্দ চোখ, আমায় ডেকোনা, দেখা হবে বন্ধু,
তোমার অরণ্যে, প্রভৃতি।
লাকী আখন্দ এর গাওয়া ও সুর-সঙ্গীতে কয়েকটি জনপ্রিয় কালজয়ী গানের মধ্যে- ‘আমায় ডেকোনা, ফেরানো যাবেনা’, ‘এই নীল মনিহার, ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে’, ‘যেখানে সীমান্ত তোমার, ‘মামনিয়া, ‘লিখতে পারি না কোনো গান, ‘ভালোবেসে চলে যেও না’, ‘বিতৃঞ্চা জীবনে আমার’, ‘কি করে বললে তুমি’, ‘এতো দূরে যে চলে গেছো’, ‘হৃদয়ের দুর্দিনে যাচ্ছে খরা’, ‘চল না ঘুরে আসি’, ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’, ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে’ ‘কে বাঁশি বাজায়রে’, ইত্যাদি।
লাকী আখন্দ তাঁর প্রতিভাদীপ্ত কাজের স্বীকৃতি তেমন একটা পাননি, দর্শক-শ্রোতাদের ভালোবাসা ছাড়া। সেই ১৯৬৯ সালে, পাকিস্তানী আর্ট কাউন্সিল হতে “বাংলা আধুনিক গান” বিভাগে পদক লাভ করেছিলেন মাত্র।
প্রতিভাবান সুরকার, গিটারিস্ট, কন্ঠশিল্পী, গীতিকার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা লাকী আখন্দ। আধুনিক বাংলা গানের অবিস্মরনীয় নাম লাকী আখন্দ। একসময়ের তুমুল জনপ্রিয় এই সঙ্গীতশিল্পী রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন স্বীকৃতি তথা পুরস্কার না পেলেও, বাংলাদেশের সঙ্গীতপ্রিয় মানুষ তাঁকে একজন শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
মেধাবী সঙ্গীতজ্ঞ ও জাতির একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, লাকি আখন্দকে এদেশের মানুষ চিরকাল মনে রাখবে ।