এ কে আজাদ: ফকির আলমগীর। কণ্ঠশিল্পী। বীর মুক্তিযোদ্ধা। প্রখ্যাত গণসংগীতশিল্পী। বরাবরই তিনি মানুষ ও মানবতার গানই বেশী গেয়েছেন। তাঁর গানের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন খেটে খাওয়া মানুষকে, গ্রামের নির্যাতিতা-বঞ্চিতা সখিনা’দেরকে। জনমদুঃখিনী মায়ের, পরম মহিমাও ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর গানের মাধ্যমে।
এদেশের গ্রাম-গঞ্জের লোকজসংগীতকে, সমসাময়িক সুরের ধারায় নিয়ে এসে, এ সব গানকে করেছেন সর্বাধিক জনপ্রিয়। যা গণমানুষের মুখে মুখে ফিরে আজও।
এই প্রখ্যাত সংগীতশিল্পীর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০২১ সালের ২৩ জুলাই, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন । মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। গুণি এই সঙ্গীতশিল্পীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
ফকির আলমগীর ১৯৫০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানার কালামৃধা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মোঃ হাচেন উদ্দিন ফকির, মা বেগম হাবিবুন্নেছা। ফকির আলমগীর, কালামৃধা গোবিন্দ হাই স্কুল থেকে ১৯৬৬ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
জগন্নাথ কলেজ থেকে স্নাতক ও পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় এমএ পাস করেন।
তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন) সদস্য হিসেবে ছাত্র রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ‘ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী’ ও ‘গণশিল্পী গোষ্ঠী’র সদস্য হিসেবে ষাটের দশকেই বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সঙ্গীতবলয়ে প্রবেশ করেন। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানেও তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন শব্দসৈনিক হিসেবে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেন ফকির আলমগীর।
গণসংগীত, পপ, ব্যান্ড আর ফোঁক ধাঁচের গানই তিনি বেশী করতেন। একসময়ে ফকির আলমগীর দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে গণসংগীত গাইতেন। তখন তাঁকে অনেকে ‘লাল ভাই’ বলে ডাকতেন। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে, পপ সংগীতে তাঁর অনন্য অবদান রয়েছে।
বরাবরই তিনি মানুষ ও মানবতার গানই বেশী গেয়েছেন। তাঁর গানের মাধ্যমে তুলে এনেছেন খেটে খাওয়া মানুষকে, গ্রামের নির্যাতিতা-বঞ্চিতা সখিনা’দেরকে। জনমদুঃখিনী মায়ের, পরম মহিমাও ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর গানের মাধ্যমে।
অনেক আধ্যাত্মিক গানও গেয়েছেন ফকির আলমগীর।
দেশের গ্রাম-গঞ্জের লোকজসংগীতকে, সমসাময়িক সুরের ধারায় নিয়ে এসে, এ সব গানকে করেছেন সর্বাধিক জনপ্রিয়। যা গণমানুষের মুখে মুখে ফিরে আজও।
ফকির আলমগীরের গাওয়া গানের সংখ্যা অগণিত। সেই অসংখ্য গানের মধ্য থেকে কিছু গান কালের সীমানায় হয়েছে তুমুল জনপ্রিয় ও কালজয়ী। তাঁরমধ্যে উল্লেখযোগ্য গান- ও সখিনা গ্যাছস কি না ভুইল্যা আমারে…,
নাম তাঁর ছিল জন হেনরি…., মায়ের একধার দুধের দাম…., মন আমার দেহ ঘড়ি…., সান্তাহার জংশনে দেখা…, কালো কালো মানুষের দেশে…., মন তুই দেখলি নারে…., আহারে কাল্লু মাতব্বর…., ও জুলেখা…., ভাত খাওনের পয়সা নাই…., অন্তর কাঁন্দে গো আমার… সখিপুরের সখিনা…, ঘর করলাম নারে আমি…, কামালিরে কাম করাইয়া…, অন্যতম।
ফকির আলমগীর টেলিভিশনে প্রচুর গান গেয়েছেন। টেলিভিশনের অনেক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে তাঁর গান প্রচার করা হতো। তাঁর গানে মডেল হয়েছেন অনেক জনপ্রিয় তারকা নায়িকাও। কোন কোন সময় তিনি নিজেও মডেল হয়েছেন। এতটাই জনপ্রিয় ছিল ফকির আলমগীর ও তাঁর গান।
চলচ্চিত্রের গানেও প্লেব্যাক করেছেন ফকির আলমগীর। ১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত, নিজামুল হক পরিচালিত ‘কোথায় যেন দেখেছি’ ছবিতে প্রথম গান গেয়েছিলেন তিনি। গানটি ছিল- ‘জাগো অনশন বন্দি ওঠো রে…।’
এরপরে ‘লিনজা’ ও ‘খোঁজ খবর’সহ আরো কয়কটি চলচ্চিত্রে কন্ঠ দেন। ‘লিনজা’ ও ‘খোঁজ খবর’ ছবিতে কন্ঠ দেয়ার পাশাপাশি অভিনয়ও করেছেন ফকির আলমগীর।
ফকির আলমগীর একজন লেখকও ছিলেন। ১৯৮৪ সালে তাঁর লেখা প্রথম বই ‘চেনা চায়না’ প্রকাশিত হয়। পরবর্তী আরো কয়েকটি বই লিখেন তিনি- মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজয়ের গান, গণ সংগীতের অতীত ও বর্তমান, অমর কথা, যাঁরা আছে হৃদয় পটে, স্মৃতি আলাপনে মুক্তিযুদ্ধ, আবহমান বাংলার লোকসংগীত, প্রভৃতি। তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়ও লেখালেখি করতেন।
একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগীত শিল্পী। ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা। প্রগতিশীল ও সকল স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম অগ্রপথিক। ছিলেন, ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই এসোসিয়েশন এর সম্মানিত আজীবন সদস্য।
ফকির আলমগীর তাঁর কাজের স্বীকৃতিতে পেয়েছেন ‘একুশে পদক’, ‘ভাষানী পদক’, ‘সিকোয়েন্স এওয়ার্ড অফ অনার’সহ আরো পেয়েছেন বিভিন্ন সংগঠন কর্তৃক অনেক পুরস্কার, পদক ও সম্মাননা।
সুদীর্ঘ সংগীতজীবনে ফকির আলমগীর নিষ্ক্রিয় থাকেননি কখনই। সবসময়ই তিনি গান করে গেছেন।
অন্যায়-অবিচার, শোষণ আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে বরাবরই তাঁর কন্ঠ ছিল সোচ্চার। মানুষ ও মানবতার কথা তিনি দরাজ কণ্ঠে ছড়িয়ে দিয়েছেন দেশের চারদিকে। তাঁর গাওয়া অসংখ্য গানের মধ্যে কিছু গান জয় করেছে সময়ের সীমানা। কিছু গান পেয়েছে প্রভুত জনপ্রিয়তা, পেয়েছে কালজয়ীর সম্মান। আর সেসব গানের মধ্যেই অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন, গণমানুষের গায়ক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফকির আলমগীর।