আজাদ আবুল কাশেম: সুভাষ দত্ত। চলচ্চিত্র পরিচালক-প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার ও শিল্পনির্দেশক। বাংলাদেশের সেরা চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে অন্যতম একজন তিনি। অসাধারণ সৃজনশীল প্রতিভাবান একজন চলচ্চিত্রকার । বিখ্যাত বিখ্যাত সব বাংলা চলচ্চিত্র নির্মান করেছেন। গল্পনির্ভর সামাজিক ছবির ব্যতিক্রমী নির্মতা তিনি। তাঁর নির্মিত প্রতিটি ছবিই দর্শক কর্তৃক সমাদৃত ও সমালোচক কর্তৃক প্রসংশিত হয়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বিরল এক প্রতিভা সুভাষ দত্ত।
দেশবরেণ্য এই চলচ্চিত্রকারের দশম মৃত্যুবার্ষিকী আজ । তিনি ২০১২ সালের ১৬ নভেম্বর, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। প্রয়াত এই বরেণ্য মানুষটির স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। তাঁর আত্মার চিরশান্তির কামনা করি।
সুভাষ দত্ত ১৯৩০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি, দিনাজপুরের মুনশিপাড়ায়, মামা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পৈতৃক বাসস্থান বগুড়া জেলার চকরতি গ্রামে।
চলচ্চিত্র নির্মাণের কৌশল শিখতে ভারতের বোম্বেতে গিয়ে পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে একটি ছায়াছবির পাবলিসিটির ষ্টুডিওতে কাজ শুরু করেন সুভাষ দত্ত। ১৯৫৩ সালে ভারত থেকে ঢাকায় ফিরে এসে যোগ দেন প্রচার সংস্থা ‘এভারগ্রিন’-এ।
১৯৫৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এ দেশের প্রথম বাংলা সবাক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’-এর স্লাইড ও বুকলেট ডিজাইনের কাজ করেছেন সুভাষ দত্ত।
১৯৫৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত, চিত্রপরিচালক এহতেশাম-এর ‘এ দেশ তোমার আমার’ চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় করেন সুভাষ দত্ত।
১৯৬৪ সালে মুক্তি প্রাপ্ত ‘সুতরাং’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন সুভাষ দত্ত। এই ছবিতে নায়ক হিসেবে তিনি নিজে অভিনয় করেন এবং নায়িকা হিসেবে প্রথম সুযোগ দেন খ্যাতিমান নায়িকা কবরী’কে।
সুভাষ দত্ত নির্মিত অন্যান্য চলচ্চিত্রসমূহ– সুতরাং, আবির্ভাব, কাগজের নৌকা, আয়না ও অবশিষ্ট, পালাবদল, আলিঙ্গন, বিনিময়, অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী, আকাঙ্ক্ষা, বসুন্ধরা, ডুমুরের ফুল, সকাল সন্ধ্যা, বলাকা মন, সোহাগ মিলন, নাজমা, সবুজসাথী, আগমন, ফুলশয্যা, সহধর্মিণী, আবদার, স্বামী-স্ত্রী, ও আমার ছেলে।
অভিনেতা হিসেবেও সুভাষ দত্ত ছিলেন বেশ জনপ্রিয় ও প্রসংশিত। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর মধ্যে- এ দেশ তোমার আমার, রাজধানীর বুকে, হারানো দিন, সুতরাং, আবির্ভাব, ক্যায়সে কুহু, পয়সে, কলকাতা’৭১(ভারতীয় বাংলা), নয়া মিছিল, কাগজের নৌকা, রূপবান, আখেরী স্টেশন, আয়না ও অবশিষ্ট, ফির মিলেঙ্গে হামদোনো, ভাইয়া, চল মান গায়ে, নতুন সুর, সূর্যস্নান, চান্দা, তালাশ, দুই দিগন্ত, সাগর, মিলন, কাজল, কার বউ, পিঞ্জর, নদী ও নারী, পালাবদল, বাল্যশিক্ষা, বিনিময়, আলিঙ্গন, চাষীর মেয়ে, ফুলশয্যা, আকাঙ্ক্ষা, আয়না, বাবা আমার বাবা, অন্যতম।
চলচ্চিত্রে তিনি নায়ক ও চরিত্রাভিনেতা হিসেবে অভিনয় শুরু করেন। তবে কৌতুকাভিনেতা হিসেবে অভিনয় করেও বেশ প্রশংসা ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন সুভাষ দত্ত। চলচ্চিত্র ছাড়াও তিনি প্রচুর মঞ্চনাটকে অভিনয় করেছেন।
চলচ্চিত্রশিল্পে তাঁর সুদীর্ঘ কর্মজীবনে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি পেয়েছেন, নানা পুরস্কার ও সম্মাননা।
১৯৬৫ সালে ‘ফ্রাংকফুর্ট চলচ্চিত্র উৎসব’-এ, সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কার লাভ করে। ১৯৬৫ সালে ‘পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসব’-এ শ্রেষ্ঠ সহ-অভিনেতার পুরস্কার লাভ করেন সুভাষ দত্ত।
এ ছাড়া ‘মস্কো চলচ্চিত্র উৎসব (১৯৬৭, ১৯৭৩ ও ১৯৭৯) ও নমপেন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’-এ (১৯৬৮) পুরস্কৃত হয়েছে তাঁর পরিচালিত চলচ্চিত্র।
১৯৭৭ সালে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’-এ তাঁর পরিচালিত ‘বসুন্ধরা’ চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র’সহ মোট পাঁচটি পুরস্কার লাভ করে।
১৯৯৯ সালে তাঁকে ‘একুশে পদক’ প্রদান করা হয়।
২০০৩ সালে ‘মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার’-এ আজীবন সম্মাননা দেয়া হয় তাঁকে। এছড়াও সুভাষ দত্ত দেশি-বিদেশি অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন।
ব্যক্তিজীবনে সুভাষ দত্ত পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন সীমা দত্তের সাথে। তাদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে। ছেলে- শিবাজী দত্ত ও রানাজী দত্ত, মেয়ে- শিল্পী দত্ত ও শতাব্দী দত্ত।
বাংলাদেশের সেরা চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে অন্যতম একজন তিনি। অসাধারণ সৃজনশীল প্রতিভাবান একজন চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্ত। আমাদের দেশীয় চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী এই ব্যক্তিত্ব, বিখ্যাত বিখ্যাত সব বাংলা চলচ্চিত্র নির্মান করেছেন। তাঁর নির্মিত প্রতিটি ছবিই দর্শক কর্তৃক সমাদৃত ও সমালোচক কর্তৃক প্রসংশিত হয়েছে।
সুভাষ দত্ত, তারকাশিল্পী গড়ার কারিগরও বটে। নিজ হাতে তৈরি করে, এদেশের চলচ্চিত্রে তিনি অনেক নায়ক-নায়িকা উপহার দিয়েছেন, যারা পরবর্তিতে তারকাশিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রের পর্দায় আলো ছড়িয়েছেন। চলচ্চিত্রশিল্পকে অসমাদৃত করেছেন তাদের অনন্য প্রতিভায়।
মিষ্টি মেয়ে নায়িকা কবরী, ডাগর কালো চোখের রূপবতি নায়িকা সুচন্দা, আবির্ভাব-এর নায়িকা শর্মিলী, মেগাস্টার নায়ক উজ্জল, সুপারস্টার নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন, কিংবদন্তী কৌতুক অভিনেতা খান জয়নুল, প্রতিভাবান অভিনেতা বেবী জামান-এসব খ্যাতিমান শিল্পীদের আবিষ্কারক সুভাষ দত্ত। এসব শিল্পীদের তিনি নিজের হাতে গড়েছেন, শিল্পের নিপুণতায়। তাঁর সাথে কাজ করেছেন, এমন অনেকেই পরবর্তীতে হয়েছে বিখ্যাত চিত্রপরিচালক।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বিরল এক প্রতিভা সুভাষ দত্ত। এধরণের প্রতিভাদীপ্ত মানুষ যুগে যুগে তো নয়-ই, হয়তো শত বছরে জন্মায় কি না সন্দেহ। একজন অনুস্মরণীয়, অনুকরণীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব। যিনি চির স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে থাকবেন, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে।