জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত শিল্পী আব্দুর রহমান বয়াতীর অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০১৩ সালের ১৯ আগস্ট, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। প্রয়াত এই গুণি শিল্পীর স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
আবদুর রহমান বয়াতী ১৯৩৯ সালের ১ জানুয়ারি, পুরান ঢাকার সূত্রাপুর থানার দয়াগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর বাবার নাম তোতা মিয়া। দয়াগঞ্জ বাজারে তাঁর বাবার একটি হোটেল ছিল । সেখানে মাঝে মধ্যেই আসতেন কিছু বাউল শিল্পী। তাঁরা গানের আসর বসাতেন । সেখান থেকেই ধীরে ধীরে তাঁর ভেতর সঙ্গীতের প্রতি আকর্ষন জন্মায় । ছোটবেলা থেকেই বাউল গান পছন্দ করতেন, যেখানে বাউল গানের আসর বসত সেখানেই ছুটে যেতেন।
আলাউদ্দিন বয়াতী, মারফত আলী বয়াতী, হালিম বয়াতী, দলিল উদ্দিন বয়াতী’সহ বিখ্যাতসব বাউলশিল্পীদের গান শুনে শুনে, নিজের ভিতরে বাউলশিল্পী হওয়ার তাগিদ অনুভব করেন। শুনা গানগুলো নিজে নিজে গাওযার চেষ্টা করতেন।
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে, সেই কৈশর বয়সেই সুরের টানে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পরেন আবদুর রহমান বয়াতী। গানের গুরু হিসেবে তিনি বেছে নেন বিখ্যাত বাউলশিল্পী আলাউদ্দিন বয়াতিকে। মূলত বাউল গানকেই জীবনের পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করেন।
১৯৮২ সালে ‘আবদুর রহমান বয়াতী’ নামে একটি বাউল দল গড়ে তোলেন । এই বাউল দল বায়না নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে গান পরিবেশন করতেন। আবদুর রহমান বয়াতী দোতারা, হারমোনিয়াম, খঞ্জনি ও ভায়োলিন বাজাতে পারতেন। দেশের বিভিন্ন অডিও ক্যাসেটের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় পাঁচশতর মতো একক গানের অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে, আবদুর রহমান বয়াতীর। এছাড়া বিভিন্ন শিল্পীর সাথে তিনি গান গেয়েছেন এমন মিশ্র অ্যালবামেও বের হয়েছে বহু।
তিনি চলচ্চিত্রের গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন । বেশ কিছু চলচ্চিত্র, নাটক ও প্রামাণ্যচিত্রে কণ্ঠ দেয়ার পাশাপাশা অভিনয় করেছেন আবদুর রহমান বয়াতি । কসাই, অসতী, হৃদয় থেকে হৃদয়’সহ কয়েকটি চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার পাশাপাশি অভিনয়ও করেছিলেন তিনি ।
টেলিভিশনের সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন চিত্রেও অভিনয় করেছেন কন্ঠশিল্পী হিসেবে। টেলিভিশনেও তিনি ছিলেন বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারের বিশেষ গ্রেডের শিল্পী ছিলেন আবদুর রহমান বয়াতী।
তাঁর উল্লেখযোগ্য বিখ্যাত গানের মধ্যে রয়েছে- মন আমার দেহঘড়ি সন্ধান করি কোন মিস্তরি বানাইয়াছে…, আমি ভুলি ভুলি মনে করি প্রাণে ধৈর্য্য মানে না…, আমার মাটির ঘরে ইঁদুর ঢুকেছে.., মরণেরই কথা কেন স্মরণ কর না…,মা আমেনার কোলে ফুটল ফুল.., ছেড়ে দে নৌকা মাঝি যাবো মদিনা…, এই পৃথিবী যেমন আছে তেমনি ঠিক রবে.. দিন গেলে আর দিন পাবি না.., এত সুন্দর রঙমহল ঘর, ইঁদুর কেটে বিনাশ করতেছে…, হাটের মাঝে ভাঙল হাঁড়ি…, আমি মরলে কেন…, ইত্যাদি।
আবদুর রহমান বয়াতী লোকসঙ্গীতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ- ২০১৫ সালে মরণোত্তর একুশে পদক লাভ করেন। তিনি আরো যেসব সংস্থা কর্তৃক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন- সিটিসেল চ্যানেল আই অ্যাওয়ার্ড, সোলস অ্যাওয়ার্ড, টেলিভিশন দর্শক ফোরাম কর্তৃক লাইফ টাইম এ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড, নজরুল একাডেমি সম্মাননা-২০০৪, সমর দাস স্মৃতি সংসদ অ্যাওয়ার্ড, বাংলাদেশ বাউল সমিতি আজীবন সম্মাননা অ্যাওয়ার্ড, লোকজ বাউলমেলা পদক-২০০৪, জাতীয় যুব সাংস্কৃতিক সংস্থার সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি স্বর্ণ পদক ও আজীবন সম্মাননা-২০০৫, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির গুণীজন সংবর্ধনা-২০০৬, মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুর সমিতি আজীবন সম্মাননা অ্যাওয়ার্ড, ওস্তাদ মোমতাজ আলী খান সঙ্গীত একাডেমি সম্মাননা পদক-২০০৬, ইউএসএ জাগরণী শিল্পীগোষ্ঠী অ্যাওয়ার্ড, স্বরবীথি থিয়েটার বাংলা নববর্ষ-১৪১২ উপলক্ষ্যে সংবর্ধনা ও সম্মাননা, কায়কোবাদ সংসদ আজীবন সম্মাননা, স্পেল বাউন্ড বিশেষ সম্মাননা, বাংলাদেশ বাউল সংগঠনের গুণীজন সম্মাননা পদক, বিক্রমপুর সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী পদক, সিটি কালচারাল সেন্টার কর্তৃক গুণীজন সম্মাননা পদক, বাউল একাডেমি পদক ও শ্রেষ্ঠ বাউলশিল্পী অডিও ক্যাসেট পুরস্কার।
অসংখ্য জনপ্রিয় লোকগানের শিল্পী, গীতিকার, সুরকার এবং সংগীত পরিচালক আব্দুর রহমান বয়াতি- পল্লীগীতি, জারি, মুর্শিদি, ভাওয়াইয়া, দেহতত্ত্বসহ বিভিন্ন ধরনের গান গাইতেন। তিনি ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ লোকসঙ্গীত শিল্পী। তাঁর অসাধারণ দরদী কণ্ঠে গাওয়া বাংলার মাটি ও মানুষের জীবনমুখী গান, হৃদয় ছুঁয়েছে সবার।
বাংলাদেশেই নয় শুধু, এই বিখ্যাত কন্ঠশিল্পী দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ছড়িয়ে ছিলেন তাঁর জনপ্রিয়তা ও খ্যাতির জ্যোতি । যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সিনিয়রের আমন্ত্রণে হোয়াইট হাউসে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে গান গেয়ে বাংলাদেশের নাম উজ্জল করেছেন তিনি। এছাড়াও ভারত, যুক্তরাজ্য, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, কানাডা, চীন, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মধ্যপ্রাচ্য’সহ পৃথিবীর বহু দেশে বাংলার বাউল গানকে ছড়িয়ে দিয়েছেন নিজের যাদুকরী কন্ঠের মাধ্যমে।
আব্দুর রহমান বয়াতী শারীরিকভাবে এই পৃথিবী থেকে চলে গেছেন। কিন্তু রেখে গেছেন তাঁর কর্ম-সৃষ্টি হাজারো গান, যা বেচেঁ থাকবে অনন্তকাল কোটি মানুষের হৃদয়ে, আর সেই গানের সাথে অনাদিকাল বেচেঁ থাকবেন- কন্ঠশিল্পী আব্দুর রহমান বয়াতী।