‘একমাত্র ব্যক্তি যাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভয় পেতাম, তিনি গ্রিজেলডা ব্লাঙ্কো নামের এক মহিলা,’ একবার বলেছিলেন কুখ্যাত মাদক সম্রাট পাবলো এসকোবার, যিনি স্বয়ং ইতিহাসের তীব্র ক্ষমতাধর ও লাভজনক মাদক বানিজ্য দল বা ড্রাগ কার্টেল তৈরি করা ব্যক্তি। ব্লাঙ্কোকে নির্দয় মনের মাস্টারমাইন্ড অপরাধী হিসেবে বর্ণনা করেন অনেকে, যার নাম শুনলে ১৯৭০ ও ‘৮০র দশকে ভয় পেতো মানুষ।
তার সম্পর্কে বলা হয়, একজন নারী যিনি মানুষকে হত্যা করেছেন, কারণ “তারা তার দিকে যেভাবে তাকাতো সেটি তার পছন্দ ছিলো না।” ‘মডার্ন ফ্যামিলি’ সিরিজখ্যাত সোফিয়া ভারগারা এই কুখ্যাত মাদক সম্রাজ্ঞীর চরিত্রে অভিনয় করছেন ‘গ্রিজেলডা’ সিরিজে। অপরাধ বিষয়ক নাটক ‘নারকোস’র নির্মাতা দলই এই সিরিজটি বানাচ্ছে।
তুমুল অ্যাকশন, ঝুঁকিপূর্ণ নাটকীয় গোলাগুলি আর গ্ল্যামারে ভরপুর ছয় পর্বের এই নেটফ্লিক্স সিরিজ। এতে গ্রিজেলডাকে একজন অত্যন্ত দুর্ধর্ষ অপরাধী হিসেবে চিত্রায়িত করে তার বুদ্ধিমত্তা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু কলম্বিয়ার ‘কোকেন গডমাদার’ হিসেবে অভিহিত, নিজের তিনজন স্বামীকে হত্যার সাথে জড়িত এই নারীর জীবনের সত্যিকারের গল্প অবশ্য বেশ অস্পষ্ট।
গ্রিজেলডা ব্লাঙ্কো কে
কলম্বিয়ায় জন্ম নেয়া ব্লাঙ্কো ১১ বছর বয়সেই অপরাধ জগতের সাথে জড়িয়ে পড়ে। ব্লাঙ্কো সে সময় এক ধনী পরিবারের ছেলেকে অপহরণের পর তার পরিবার মুক্তিপণ দিতে অস্বীকার করায় তাকে গুলি করে হত্যা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে ।
এরপর ২১ বছর বয়সে ১৯৬৪ সালে ব্লাঙ্কো তার তিন সন্তান ও স্বামীকে নিয়ে অবৈধভাবে নিউইয়র্কে অভিবাসী হয়ে যান এবং সেখানে গাঁজা বিক্রি করা শুরু করেন। কলম্বিয়াতেই বেড়ে উঠা ভারগারা বিবিসিকে বলছিলেন, “এটা মনে রাখা খুবই জরুরি যে গ্রিজেলডা ব্লাঙ্কো তার জীবনের শুরুর দিকে কে ছিলেন। একজন অভিবাসী যে সম্পূর্ণ একা তার তিন সন্তানকে লালন-পালন করছিল। তার কিছুই ছিল না, বেঁচে থাকার জন্য তার না ছিল শিক্ষা, না ছিল কোনও হাতিয়ার।”
সিরিজটির পরিচালক এরিক নিউম্যান বলেছেন, তিনি গ্রিজেলডা ব্লাঙ্কোর এই ‘জটিল চরিত্রকে মানবিক’ করে তুলে আনতে চেয়েছেন। সহকারী পরিচালক আন্ড্রেজ বেইজ বলেছেন, “পুরুষের জগতে সে একজন নারী, নিজেকে প্রমাণ করতে সে দশগুণ বেশি পরিশ্রম করেছে এবং নিজের চারপাশে থাকা পুরুষদের ছাড়িয়ে যেতে নিজের বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা ব্যবহার করেছে। লোকজন তাকে সম্পূর্ণ বিনাশ করার জন্য পদক্ষেপও নিয়েছে এক সময়।”
‘ক্ষমতা তাকে দানবে পরিণত করেছে’
ব্লাঙ্কো ১৯৭০ সালে তার প্রথম স্বামীকে হত্যার নির্দেশ দিয়ে মিয়ামিতে চলে গিয়েছিল। সেখানে তার দ্বিতীয় স্বামী মাদক পাচারকারী আলবার্টো ব্রাভোর সাথে তার দেখা হয়, যে তাকে মাদকের আন্ডারওয়ার্ল্ডের আরও অন্ধকার জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়।
ব্লাঙ্কোর সহিংস মনোভাব আর মাদক চোরাচালানে সাহসী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, যা তাকে তরুণীদের কলম্বিয়া থেকে আমেরিকায় ব্রা কিংবা অন্তর্বাসের ভেতরে কোকেন লুকিয়ে উড়ে যেতে সহায়তা করেছে। এর অর্থ এটাই যে অচিরেই পুরো অপরাধ সাম্রাজ্য তার হাতের মুঠোয় চলে যায়।
মিয়ামিতে মাদক যুদ্ধ আরও তীব্র হওয়ার পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলো সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিল, যা ব্লাঙ্কোকে আরও বেশি নির্মম করে তোলে। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে স্বামীকে গুলি করে ব্লাঙ্কো, কারণ তার বিশ্বাস ছিল যে তার স্বামী তার টাকা চুরি করেছে।
এরপর ১৯৮৩ সালে ব্লাঙ্কো তার তৃতীয় স্বামীকে খুন করে মিয়ামি ছেড়ে চলে যায়। সে সময় তার সাথে এই দম্পতির ছেলে মাইকেল করলিওনি ছিল। নির্দয় ও নির্মম আচরণের জন্য ব্লাঙ্কোকে ‘ব্ল্যাক উইডো’ বা ‘কালো বিধবা’ নামেও অভিহিত করা হয়।
সে সময় ব্লাঙ্কোর সাম্রাজ্য আরও বিস্তৃত হয় এবং ১৯৮০’র দশকের গোড়ার দিকে সে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও দুর্ধর্ষ মহিলায় পরিণত হয়, যে প্রতি মাসে এক দশমিক পাঁচ টন কোকেন পাচার তদারকি করতো।
ভারগারা বিবিসিকে বলছিলেন, “আমি সত্যিই মনে করি যে যখন গ্রিজেলডা মিয়ামিতে প্রথম যায় তখন তার উদ্দেশ্য ছিল শুধু পরিবারকে দেখাশোনা ও রক্ষা করা। কিন্তু এই অন্ধকার পথে সে হারিয়ে যায় এবং ক্ষমতা ও অর্থ তাকে একজন দানবে পরিণত করে।”
নিজের সাম্রাজ্য ত্যাগ করতে ১৯৮০’র দশকে প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষের দেয়া ১৫ মিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ব্লাঙ্কো।
অদক্ষ ব্যক্তিদের উপর নির্ভর করা
দুই দশক ধরে কঠোরভাবে মিয়ামিতে মাদক সাম্রাজ্য পরিচালনা করলেও নারী হিসেবে ব্লাঙ্কো সম্পূর্ণ সচেতন ছিল যে, মাদক ইন্ডাস্ট্রি একচেটিয়াভাবে উগ্রবাদী পুরুষরাই চালায়, যেখানে তার অবস্থান অনিশ্চিত ছিল।
এই যুক্তিতে ব্লাঙ্কো তার ব্যবসা পরিচালনা করতে সেসময় একজন পুরুষকে অনুমতি দেয়–স্থানীয় ডিলাররা তখনই “চুক্তি গ্রহণ করে যখন তা কোনও পুরুষের মুখ থেকে বের হয়।” এক হত্যা মামলায় ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের পর ব্লাঙ্কো নিজের ব্যবসা নিজেই পরিচালনা করার দায়িত্ব বেছে নেয় এবং নিজের সুবিধার জন্য তার বহিরাগত অবস্থানকে ব্যবহার করে।
আনুমানিক এক লাখ ৩৫ হাজার কিউবান ১৯৮০ সালের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে আমেরিকায় অভিবাসী হয় যারা ‘মারিলিটোস’ নামে পরিচিত। এদের অনেকেই আবার ক্রিমিনাল গ্যাং বা অপরাধী চক্র, মাদক পাচার, কন্ট্রাক্ট কিলিং বা চুক্তিতে মানুষ হত্যার মতো অপরাধে আগে থেকেই জড়িত ছিল।
ব্লাঙ্কো এটাকে পুঁজি করে তাদেরকে নিজের গ্যাংয়ে নিয়োগ করে। হিটম্যান, গোলন্দাজ অর্থাৎ যারা পিস্তল চালাতে পারদর্শী, তাদেরকে নিয়ে ব্লাঙ্কোর দল তৈরি হয়, যারা মোটরসাইকেলে চড়ে গুপ্তহত্যা করতে পরিচিত হয়ে উঠেছিল।
নেটফ্লিক্সের সিরিজটির সহকারী পরিচালক আন্ড্রেজ বেইজ বলছিলেন, “ব্লাঙ্কো নিজে একজন অভিবাসী বা বহিরাগত এবং তার আশেপাশেও সব বহিরাগতদের নিয়োগ দেয় সে। এরকম ইন্ডাস্ট্রিতে যেখানে বিশ্বাস অর্জন করা খুব কঠিন এবং আরও কঠিন তা ধরে রাখা, ব্লাঙ্কো জানতো যে সে কী করছে।”
“এরা সবাই অদক্ষ ছিল, সমাজের স্বাভাবিক মানের সাথেও এরা যায় না। গ্রিজেলডা এটা জানতো এবং তাদের উপলব্ধি করতে সাহায্য করতো যে তারা তার পরিবারের অংশ,” যোগ করেন বেইজ।
“আমি একজন কলম্বিয়ান, একজন মা এবং একজন অভিবাসী। একজন নারী হিসেবে গ্রিজেলডাকে বিবেচনা করা হতো এবং এখন আমি জানি কারণ আমার উচ্চারণের কারণে আমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয় এবং আমি অন্যদের চাইতে কম সুযোগ পাই,” বলছিলেন ভারগারা।
‘একজন নারী কখনও এমন খারাপ হতে পারে না’
ব্লাঙ্কোর অপরাধ সাম্রাজ্য ১৯৮০’র দশকের মাঝের দিকে উন্মোচিত হতে শুরু করে এবং ক্যালিফোর্নিয়ার আরভিনে গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার সন্ত্রাসের রাজত্ব হঠাৎ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়।
কিন্তু কীভাবে দুই দশক ধরে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে ব্লাঙ্কো মিয়ামিকে মাদক নিয়ে খেলার মাঠে রূপান্তরিত করেছিলেন? ব্লাঙ্কো একজন নারী, এটাকেই কারণ বলে দেখিয়েছে ‘গ্রিজেলডা’ সিরিজটি।
“কারণ সে একজন নারী ছিল। সে যখন চাইতো তখনই অদৃশ্য হয়ে যেতে পারতো। কেউ ভাবতেও পারতো না যে একজন নারী এই আকারের একটি দল পরিচালনা করতে পারে। মানুষ ভাবে একজন নারী কখনও এরকম খারাপ হতে পারে না,” ভারগারা বলছিলেন।
পুরুষশাসিত মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে দৃঢ় ছিল যে একজন নারী কখনও মাদক ব্যবসার পিছনে জড়িত থাকতে পারে না। কেউ কেউ একেবারে এই লাইনেই তদন্তের জন্য জোর দেয়।
তবে ১৯৭০’র দশকের শুরু থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত ব্লাঙ্কোকে ধরার দায়িত্ব ছিল মিয়ামি পুলিশ বিভাগের একজন নারী গোয়েন্দা বিশ্লেষক জুন হকিন্সের।
পরিচালক নিউম্যান হকিন্সকে এই গল্পের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে মনে করেন।
“সে গ্রিজেলডার প্রতিরূপ, সে নিজেও একজন লাটিন তরুণী ও সিঙ্গেল মা – যে এমন একটি বিশ্বে কাজ করছে যেখানে নারীদেরকে অবমূল্যায়ন করা হয়। সে এটা দেখাতে চায় যে গ্রিজেলডা যা বেছে নিয়েছে, সেটা তার একমাত্র অপশন বা পথ ছিলো না।”
কী ঘটেছিল গ্রিজেলডা ব্লাঙ্কোর ভাগ্যে?
এরপর ১৯৮৫ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি ব্লাঙ্কো তার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার হয়। কোকেন উৎপাদন, আমদানি ও বিতরণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয় সে।
ব্লাঙ্কোর বিরুদ্ধে আরও তিনটি হত্যার অভিযোগ আনা হয় এবং প্রায় দুই দশক সে কারাগারে কাটায়।
কারাভোগের সময়ই ব্লাঙ্কোর তিন ছেলেকে হত্যা করা হয়। পরে ২০০৪ সালে মুক্তি পেয়ে ব্লাঙ্কো কলম্বিয়ায় নির্বাসনে যায় এবং সেখানে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করে।
কয়েক বছর পর ২০১২ সালের তেসরা সেপ্টেম্বর মোটরবাইকে আসা এক ব্যক্তি ৬৯ বছর বয়সী ব্লাঙ্কোকে গুলি করে।
ব্লাঙ্কোকে যে স্টাইলে গুপ্তহত্যা করা হয়, তা অবিকল তার রাজত্বে গড়ে তোলা মানুষ হত্যার স্টাইলের মতোই।
“এ হত্যাকাণ্ড তার প্রতি ঘৃণার মাত্রা প্রমাণ করে। সে ২০১২ সালে ছিল একজন নিরীহ মহিলা, নির্জনে একাকী বাস করতো এবং তার চার সন্তানের মধ্যে তিনজনই মারা গিয়েছিল,” বিবিসিকে বলেন নিউম্যান।
বেইজ যোগ করেন, “সে কোনও কিছু থেকে উঠে আসেনি, সে অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল, কিন্তু গল্পের একেবারে শেষে এসে এটা এমন একটা ট্রাজেডিতে পরিণত হয় যার পুরোটাই লস।”
ব্লাঙ্কোর জীবন ও ক্ষমতার আকর্ষনীয় কাহিনী হওয়া সত্ত্বেও ইতিহাসের বইগুলোতে তার উপস্থিতি সেভাবে নেই।
এমনকি ভারগারা, কলম্বিয়ায় যিনি ‘মাদক যুগে’ বেড়ে উঠেছেন তিনিও বলছেন যে কখনও এই নারী সম্পর্কে শোনেননি। ব্লাঙ্কোর জীবন সম্পর্কে জানার পর তার মনে হয়েছিল যে, এটা “অসম্ভব”, কিন্তু এটা ছিল সত্যি গল্প।
“এই কারণেই আমি গ্রিজেলডার চরিত্রে অভিনয় করতে চেয়েছিলাম। সে একাধারে একজন মা, খলনায়ক, প্রেমিকা এবং খুনিও। সে সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছে মানুষ কত জটিল হতে পারে।” সূত্র : বিবিসি বাংলা।