তারুণ্যদিপ্ত এক ক্ষণজন্মা স্টাইলিস্ট চিত্রনায়ক সালমান শাহ। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নায়ক হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। দর্শকপ্রিয় এই নায়ক, আজ থেকে ২৫ বছর আগে ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর, আজকের এই দিনে রহস্যময়ভাবে মৃত্যুবরন করেন।
মাত্র ২৫ বছরের টগবগে যুবক, তরুণ-তরুণীদের স্বপ্নের নায়ক হারিয়ে গেলেন অজানা এক দেশে। অকালপ্রয়াত এই চিত্রনায়কের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
সালমান শাহ (শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন) ১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর, সিলেট শহরের দাড়িয়াপাড়াস্থ নানা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কমর উদ্দিন চৌধুরী একজন বিচারক, মা নীলা চৌধুরী । সালমান শাহ পড়াশুনা শুরু করেন খুলনার ‘বয়রা মডেল হাইস্কুল’-এ। ১৯৮৭ সালে তিনি ঢাকার ‘ধানমন্ডি আরব মিশন স্কুল’ থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ‘আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ’ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও ধানমন্ডির ‘মালেকা সায়েন্স কলেজ’ (বর্তমান ডক্টর মালিকা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ) থেকে বি.কম পাস করেন। বলতে গেলে সাংস্কৃতিক পরিবারেই তাঁর জন্ম, মা গায়িকা ও টিভি অভিনেত্রী, নানা কামরুজ্জামান ছিলেন এদেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’-এর অভিনেতা। মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সালমান শাহ গান শিখেন ‘ছায়ানট’ থেকে, কিন্তু গায়ক না হয়ে, হয়ে যান নায়ক। নানার পদাঙ্ক অনুসরণ করে হন অভিনেতা। জানা যায়, ১৯৮৩ সালে একটি চায়ের বিজ্ঞাপনে অভিনয়ের মাধ্যমে তাঁর ছোট পর্দায় অভিষেক ঘটে।
১৯৮৫ সালে, সালমান শাহ অভিনীত প্রথম নাটক ‘আকাশ ছোঁয়া’ বিটিভিতে প্রচারিত হয়। সালমান শাহ আরো অভিনয় করেন- দেয়াল, সব পাখি ঘরে ফিরে, সৈকতে সারস, নয়ন, পাথর সময় ও ইতিকথা নাটকে।
১৯৯৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত, সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিতে নায়ক হয়ে চলচ্চিত্রে আসেন সালমান শাহ । তাঁর আগে চলচ্চিত্রের ক্যামেরার সামনে দাড়িয়েছিলেন আলমগীর কবিরের আসমাপ্ত ‘হাঙর নদী’ (রুপসী মা) চলচ্চিত্রে রইসের ভুমিকায়– ছবিটি অসমাপ্ত ছিল। তাঁর অভিনীত অন্যান্য ছবিগুলো হলো- তুমি আমার, রঙ্গীন সুজন সখি, অন্তরে অন্তরে, স্নেহ, প্রেমযুদ্ধ, কন্যাদান, দেনমোহর, বিক্ষোভ, স্বপ্নের ঠিকানা, আঞ্জুমান, মহামিলন, আশা ভালবাসা, বিচার হবে, এই ঘর এই সংসার, প্রিয়জন, তোমাকে চাই, স্বপ্নের পৃথিবী, সত্যের মৃত্যু নাই, জীবন সংসার, মায়ের অধিকার, চাওয়া থেকে পাওয়া, প্রেম পিয়াসী, স্বপ্নের নায়ক, শুধু তুমি, আনন্দ অশ্রু, বুকের ভিতর আগুন।
বাংলা চলচ্চিত্রের এই ক্ষণজন্মা নায়কটি, ধুমকেতুর মতো এসেছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য। চলচ্চিত্র ব্যবসায় সুবাতাস বয়ে দেয়ার জন্য। সুপার-ডুপার হিট ছবি চলচ্চিত্রশিল্পকে উপহার দেয়ার জন্য। লক্ষ-কোটি সিনেমাদর্শকদের মন জয় করার জন্য। তরুণ-তরুণীদের হৃদয় হরণ করার জন্য।
তাঁর অভিনয় দক্ষতায়, চলনে-বলনে, পোশাকে ছিল নতুনত্ব আর আধুনিকতার ছোঁয়া। তরুণ সিনেমা দর্শকদের স্টাইল আইকন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সালমান শাহ’ই ছিলেন একমাত্র চিত্রনায়ক, যিনি সর্বমহলে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে পেরেছিলেন। সত্যিকার অর্থে তারকা নায়ক বলতে যা বুঝায় তিনি ছিলেন তাই। তাঁর প্রায় প্রতিটি ছবিই ছিল ব্যবসাসফল, সুপার-ডুপার হিট।
চলচ্চিত্র জগতে এসে সালমান শাহ পেয়েছিলেন খ্যাতি-অর্থ-জশ আর কোটি ভক্তের হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা। মৃত্যুর পর তাঁর ভক্ত-অনুরাগী কয়েকজন নিজেরাই আত্মহননের পথ বেছে নেন। দর্শক-ভক্তদের এমন পাগলকরা ভালবাসা পাওয়া সত্যিই বিরল। দর্শককুলের এতো ভালবাসার নায়কটি, কি এক অজানা কারনে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন- তা আজও রহস্যাবৃত রয়ে গেছে। বাংলাদেশের দর্শকনন্দিত চিত্রনায়ক প্রয়াত সালমান শাহ বেচেঁ আছেন/বেচেঁ থাকবেন তাঁর কর্মে, লক্ষ কোটি দর্শক-ভক্তদের হৃদয়ে।