২০২১ সাল। অসীমের পানে মহাকালের যে যাত্রা, সেখানে সূচিত হল আরেকটি মাইলফলক। এই যে মহাকালের যাত্রা, সেখানে একেকটি বছর আসে নতুন উদ্দীপনা ও প্রেরণা নিয়ে। আমরা মুছে ফেলি গত হয়ে যাওয়া বছরের গ্লানি, উৎসাহ খুঁজে পাই সুখকর ঘটনাগুলো থেকে, তারপর এগিয়ে যাই অগ্রগতির দিকে।
কেমন কেটেছে আমাদের বিদায়ী বছরটি? বিগত অন্য বছরগুলোর তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল সে বছর। এ শতকে এমন সময় আর আসেনি। বছরের শুরুতেই করোনা নামের এক প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে সারা পৃথিবীতে, বছরের শেষদিন পর্যন্ত যা অব্যাহত ছিল। করোনাভাইরাস কেবল মানুষের জীবনকেই সংকটাপন্ন করেনি, হুমকিতে ফেলেছে মানুষের জীবিকার পথও। করোনার সংক্রমণ রোধে দেশে দেশে ঘোষণা করা হয় লকডাউন। আমাদের দেশেও একটানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি তথা ‘লকডাউন’ থাকার কারণে অফিস-আদালত, কলকারাখানা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বড় দোকানপাট বন্ধ ছিল। এর ফলে বন্ধ হয়ে গেছে অনেকের আয়ের পথ। বেকার হয়ে পড়েছেন বহু মানুষ। গণপরিবহন বন্ধ ছিল ৬৮ দিন। করোনার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে শিক্ষা খাতে। দীর্ঘ ১০ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। তাই সারাবিশ্বের মানুষের মতো আমরাও এ পরিস্থিতির অবসানের অপেক্ষায় আছি। আশা করছি, করোনার টিকা প্রদান শুরু হওয়ার পর সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে নতুন বছরে।
বিদায়ী বছরটি ছিল এক কথায় প্রিয়জন হারানোর বছর। করোনা সংক্রমণে অথবা করোনাজনিত প্রভাবের কারণে অসংখ্য বিশিষ্টজনকে হারিয়েছি আমরা। বিদায়ী বছরে আমরা যাদের হারিয়েছি তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামান, জামিলুর রেজা চৌধুরী, এমাজউদ্দীন আহমদ, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. সা’দত হুসাইন, শিল্পী মুর্তজা বশীর, সাংবাদিক কামাল লোহানী, রাহাত খান, মুনিরুজ্জামান, ব্যারিস্টার রফিকুল হক। হারিয়েছি রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ নাসিম, সাহারা খাতুন, শাজাহান সিরাজকে। হারিয়েছি যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান বিশিষ্ট শিল্পপতি নুরুল ইসলামসহ আরও অনেক ব্যবসায়ী-শিল্পপতিকে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আবদুল মোনেম, লতিফুর রহমান ও এমএ হাসেম। হারিয়েছি মুক্তিযুদ্ধের দুই সেক্টর কমান্ডার সিআর দত্ত ও আবু ওসমান চৌধুরীকে। নাট্যব্যক্তিত্ব আলী যাকের, সঙ্গীত পরিচালক আলাউদ্দীন আলী ও আজাদ রহমান, সংগীত শিল্পী অ্যান্ড্র– কিশোর ও ফুটবলার বাদল রায়কেও এ বছর হারিয়েছি আমরা। করোনা কেড়ে নিয়েছে দেশের বহু চিকিৎসক, সাংবাদিক, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তার প্রাণ। বিএমএ’র তথ্যমতে, করোনা সংক্রমিত হয়ে বা করোনা উপসর্গ নিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১২৩ জন চিকিৎসক। মৃত্যু হয়েছে ৪১ জন সাংবাদিকের। আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে হারিয়েছি- বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, কিংবদন্তি ফুটবলার দিয়েগো মারাডোনাকে। তাদের সবার প্রতি রইল আমাদের অশেষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
বিদায়ী বছরে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা হওয়ায় দেশের কৃষি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে আশাব্যঞ্জক খবর হল, করোনার প্রভাবে সারা বিশ্বের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সরকারের সঠিক ও দ্রুত পদক্ষেপের ফলে আমাদের দেশে এর প্রভাব পড়েছে তুলনামূলক কম। রেমিটেন্স এসেছে রেকর্ড পরিমাণ। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে পর্যাপ্ত। রফতানি খাত আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। আমরা আশা করছি, এসবের ফলে নতুন বছরে দেশের অর্থনীতি করোনার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে।
২০২১ সাল আমাদের জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর। আমাদের স্বাধীনতা ও বিজয়ের ৫০ বছর তথা সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপিত হবে এ বছর। আমরা আশা করব, মানুষের অদম্য স্পৃহা ও উদ্ভাবনী শক্তির কাছে হার মানবে করোনাভাইরাস। পৃথিবীতে আবার ফিরে আসবে শান্তি। জনগণ, সরকার, রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা নতুন বছরটিকে শান্তি-সমৃদ্ধময় ও তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলবেন। সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা।