করোনাকালে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকারঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন সম্পর্কে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) জরিপে যে তথ্য-উপাত্ত উঠে এসেছে, তা রীতিমতো হতাশাজনক। গত এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত পরিস্থিতি বিবেচনা করে জুলাইয়ে ৫০১টি প্রতিষ্ঠানের ওপর জরিপ করে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।
শনিবার অনলাইনে সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশিত জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা পায়নি ৬৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান। ১৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের মালিক বলেছেন, তাঁরা প্রণোদনা প্যাকেজ সম্পর্কে কিছু জানেন না। বাকি ২১ শতাংশের মতো প্রতিষ্ঠান প্রণোদনার অর্থ পেয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠান আর্থিক প্রণোদনা তথা ঋণ পেয়েছে, করোনাকালের ক্ষতি কাটিয়ে সহজে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা তুলনামূলক কম। ৬৫ দশমিক ৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠান আর্থিক ক্ষতি সামাল দিতে ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের ওপর নির্ভর করেছে, ২৮ দশমিক ১ শতাংশ প্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়েছে, ১৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করেছে, ৮ দশমিক ৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতন কমিয়েছে।
সানেমের জরিপে আরও বেরিয়ে এসেছে যে করোনাকালে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সে ক্ষেত্রে তাঁদেরই বেশি প্রণোদনা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বাস্তবে তাঁরাই কম প্রণোদনা পেয়েছেন। গত এপ্রিল-জুন সময়ে আগের প্রান্তিকের চেয়ে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ফলে ব্যবসায়ীদের আস্থাও কমেছে। যেখানে আগের প্রান্তিকে আস্থা ছিল ৫৮ শতাংশ, সেখানে এই প্রান্তিকে এসে দাঁড়িয়েছে ৪১ শতাংশে। ৬৪ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার দুর্বল। মাত্র ৯ শতাংশ বলেছেন, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সবল।
উল্লেখ্য, করোনা মহামারির অর্থনৈতিক অভিঘাত কাটাতে সরকার ঋণ আকারে কয়েক দফায় ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। যার মধ্যে ছিল শিল্পঋণের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা, রপ্তানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ বাবদ পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো করোনার এই দুঃসময়ে সরকারঘোষিত প্রণোদনার টাকা পেতে উদ্যোক্তাদের ঘুষ দিতে হয়েছে। সানেমের জরিপ অনুযায়ী, ২৯ শতাংশ উদ্যোক্তা কিংবা তাদের প্রতিনিধি ঘুষ দাবির অভিযোগ করেছেন। ৪৭ শতাংশ হ্যাঁ কিংবা না কিছু বলেননি। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ ধরে নেওয়া হলে ৭৬ শতাংশ উদ্যোক্তাকে প্রণোদনা ঋণ নিতে ঘুষ দিতে হয়েছে অথবা তঁাদের কাছে ঘুষ চাওয়া হয়েছে।
আমাদের ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোতে আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ বেশ পুরোনো। খেলাপি বা মন্দ ঋণের জন্য ব্যাংকের একশ্রেণির কর্মকর্তার দায়ও কম নয়। ‘জেনে শুনে বিষ পান’ করার মতো তঁারা এমন লোকদের ঋণ দিয়ে থাকেন, যা কখনো ফেরত পাওয়া যাবে না। আবার অনেক সময় ঘুষ দিতে না পারায় সৎ উদ্যোক্তারাও ব্যাংকঋণ পান না।
ব্যাংকগুলো উদ্যোক্তাদের যে ঋণ দিয়েছে, তার সুদের সিংহভাগ সরকার পরিশোধ করেছে। বাকিটা দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। সে ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো সরকার ও উদ্যোক্তা উভয়কে ঠকিয়েছে। সানেমের প্রতিবেদনে প্রণোদনা দিতে ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে উৎকোচ নেওয়ার যে গুরুতর অভিযোগ এসেছে, সরকারের উচিত তার সুষ্ঠু তদন্ত করা এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া। করোনাকালে সরকারের প্রণোদনা নিয়ে ব্যাংকগুলোর স্বেচ্ছাচারিতা ও অসাধুতা কোনোভাবেই