নদীমাতৃক বাংলাদেশের অস্তিত্ব অনেকাংশেই নির্ভর করে নদীর অস্তিত্বের ওপর। সে কারণেই বলা হয় নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী করছি? নদী ভরাট করছি, স্থাপনা তৈরি করছি, নদীর গতিপথ আটকে দিচ্ছি। ফলে নদীর মৃত্যু হচ্ছে। বিভিন্ন রেকর্ডে দেখা যায়, দেশে একসময় নদী ছিল সাত শতাধিক। বর্তমানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) হিসাবে কোনো রকমে টিকে আছে ৪৩০টি নদী।
প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৯৭১ সালে হবিগঞ্জ জেলায় নদী ছিল ৫৫টি। নদী কমিশনের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে সেখানে নদী রয়েছে ২৮টি। বাস্তবে নদীর সংখ্যা আরো কম। এভাবে নদীর অপমৃত্যু হলেও নদী রক্ষায় আমাদের উদ্যোগ খুবই সীমিত। উদ্যোগের সততা নিয়েও রয়েছে সন্দেহ।
গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ৪৮ নদীর অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরির জন্য ২০১৭ সালের জুলাইয়ে তিন বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এর কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালে এবং শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২১ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু কভিড মহামারির কারণে কাজ শেষ হয় ২০২২ সালের ডিসেম্বরে।
প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ২৯ কোটি টাকা। প্রকল্পের পরিচালিত সমীক্ষায় দখলদারের তালিকা নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী সারা দেশে দখলদারের সংখ্যা পাওয়া যায় ৫৭ হাজার ৩৯০ জন। একই বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে নতুন দখলদারের সংখ্যা হয় আরো পাঁচ হাজার। ফলে মোট দখলদারের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৩ হাজার ২৪৯। প্রকল্পের মেয়াদ শেষে যে প্রতিবেদন তৈরি করা হয় তাতে দখলদারের সংখ্যা উল্লেখ করা হয় ৩৭ হাজার ৩৯৬ জন।
কিন্তু সেই তালিকাও প্রকাশ করছে না কমিশন। আগে ওয়েবসাইটে দেওয়া তালিকাও সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে কোনো মুদ্রিত প্রতিবেদনেও দখলদারদের নাম আসবে না। এমনকি প্রকল্পের প্রতিবেদনও কমিশন গ্রহণ করেনি বলে জানা গেছে এসব প্রতিবেদন থেকে। তার অর্থ, সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করতে যে ২৯ কোটি টাকা খরচ হয়েছে তার পুরোটাই গচ্চা গেছে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রচলিত আইন-কানুন মেনে এবং জিআইএস পদ্ধতি অনুসরণ করে দখলদারদের যে তালিকা তৈরি করা হয়েছে তা সঠিক এবং বৈধ। নদী বিশেষজ্ঞ এবং পরিবেশবাদীরাও কমিশনের এমন সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তাঁদের মতে, কমিশনের এই সিদ্ধান্ত সারা দেশে নদী দখলদারদের আরো উৎসাহিত করবে। নদীর মৃত্যু আরো ত্বরান্বিত হবে।
উচ্চ আদালত নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করেছেন। নদী রক্ষায় দফায় দফায় নির্দেশনা দিয়েছেন। নদী রক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেই সরকার আইন প্রণয়নের মাধ্যমে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গঠন করেছে।
তার পরও সরকারি অর্থে পরিচালিত সমীক্ষায় উঠে আসা দখলদারদের তালিকা প্রকাশ করা নিয়ে এমন লুকোচুরি কেন? আমরা চাই, অবিলম্বে সারা দেশের অবৈধ নদী দখলদারদের তালিকা প্রকাশ করা হোক এবং নদী দখলমুক্ত ও নাব্য করার জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ নেওয়া হোক।