শারীরিক অসুস্থতার মতোই একটি অতি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া মানসিক অসুস্থতা। বংশগত কারণে কিংবা শরীরের প্রাণরাসায়নিক প্রক্রিয়ার অসংগতি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাসহ আরো অনেক কারণেই মানসিক অসুস্থতা দেখা দিতে পারে। কিন্তু মানসিক সমস্যাকে স্বীকার করা এবং চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে চরম অনীহা। ঝাড়ফুঁক বা কবিরাজি চিকিৎসার নামে চলে সময়ক্ষেপণ। এটি হয় মূলত অজ্ঞতা ও অসচেতনতার কারণে।এর ফলে রোগের প্রকোপ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তখন চিকিৎসকের কাছে গেলেও আরোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। এসব রোগী তখন পরিবার ও সমাজের বোঝা হয়ে যায়। আবার মানসিক রোগের চিকিৎসার সুযোগও অনেক কম। হাসপাতালের সংখ্যা, শয্যাসংখ্যা, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বা সেবা প্রদানে দক্ষ কর্মীর সংখ্যাও অত্যন্ত কম। গতকাল কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে দেশের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সেই অপ্রতুলতা। চিকিৎসকরা সাধারণত মানসিক সমস্যাকে দুই ভাগে ভাগ করে থাকেন—গুরুতর ও সাধারণ সমস্যা। গুরুতর সমস্যার মধ্যে রয়েছে সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার মুড ডিস-অর্ডার, স্মৃতিভ্রংশতা, আলঝেইমারস ইত্যাদি। আর সাধারণ সমস্যার মধ্যে রয়েছে দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা, শুচিবায়ু বা অবসেসিভ কমপালসিভ ডিস-অর্ডার, ফোবিয়া বা অহেতুক ভীতি, বিষণ্নতা ইত্যাদি।
সব ধরনের সমস্যায়ই চিকিৎসকের সহায়তা নেওয়া প্রয়োজন। আর গুরুতর সমস্যাগুলোর চিকিৎসা না নিলে রোগী নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তারা নিজের জীবন পরিচালনায় অক্ষম হয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, প্রায় ১ শতাংশ মানুষ গুরুতর মানসিক সমস্যা সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। এতে রোগীর মধ্যে ভুল ধারণা, অবাস্তব চিন্তা-ভাবনা, অকারণ সন্দেহ, বিভ্রান্তি, বিড়ম্বনা ইত্যাদি দেখা যায়। রোগীর ডিল্যুশন বা হেলুসিনেশনও হতে পারে। সেই হিসাবে বাংলাদেশে ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে অন্তত ১৭ লাখের এই সমস্যা রয়েছে। কিন্তু এর ১ শতাংশও চিকিৎসকের কাছে যায় না কিংবা যখন যায় তখন আর করার প্রায় কিছুই থাকে না।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কর্মকৌশল পরিকল্পনা ২০২০-৩০-এ বলা হয়েছে, দেশে প্রায় তিন কোটি মানুষ কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছে। এদের ৯৪ শতাংশই থেকে যায় চিকিৎসার বাইরে। চিকিৎসার সুযোগও অত্যন্ত কম। সরকারিভাবে রয়েছে ২০০ শয্যার জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ৫০০ শয্যার পাবনা মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতাল, ৪০ শয্যার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা রয়েছে।এই সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য। বেসরকারিভাবে কিছু উদ্যোগ থাকলেও সেগুলোর মান নিয়ে রয়েছে অনেক প্রশ্ন। চিকিৎসার খরচও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। নির্যাতন করে রোগীকে মেরে ফেলার অভিযোগও রয়েছে। এই খাতে সরকারের বাজেট বরাদ্দও অত্যন্ত কম। জানা যায়, স্বাস্থ্য বাজেটের মাত্র ০.৫ শতাংশ বরাদ্দ পাওয়া যায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য।শারীরিক সুস্থতার জন্যও মানসিক সুস্থতা অত্যন্ত জরুরি। শরীর ও মন একটিকে ছাড়া আরেকটির সুস্থতা সম্ভব নয়। জনস্বাস্থ্যের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে এমন অবহেলা কাম্য নয়। আমরা চাই, মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হোক।