বাংলাদেশের বুকজুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য নদী-নালা, খাল-বিল। বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি সেভাবেই তৈরি। এর উদ্ভিদ, প্রাণবৈচিত্র্য, ফসলের ধরন—সব কিছুই সেই প্রতিবেশ ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু মানুষের অযাচিত হস্তক্ষেপ ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন সেই ভূ-প্রকৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
ফল হচ্ছে আত্মঘাতী। অপরিকল্পিত উন্নয়ন অনেক ক্ষেত্রেই গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিচ্ছে। যেমনটি দেখা যাচ্ছে যশোরে। ২১৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ভৈরব নদ খননের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় ২০১৭ সালে। খননকাজ অর্ধেকেরও বেশি সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু খননের সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অপরিকল্পিতভাবে তৈরি ২৯টি সেতু। এগুলো এতটাই নিচু ও সংকীর্ণ যে এগুলোর নিচ দিয়ে কোনো নৌযান চলার মতো অবস্থা নেই। পানির প্রবাহও বাধাগ্রস্ত হয়।
প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভৈরব নদের যশোর অংশের ৯৬ কিলোমিটারে মোট ৫১টি সেতু রয়েছে। এর মধ্যে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের ২৩টি, সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের চারটি, ত্রাণ ও পুনর্বাসন অধিদপ্তরের ১৯টি, রেলওয়ের একটি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের একটি এবং কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের তিনটি সেতু রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ২৯টি সেতু এতটাই নিচু ও সংকীর্ণ যে নৌচলাচলের উপযোগী নয়। সেতু নির্মাণের জন্য কোথাও কোথাও নদের প্রস্থের পাঁচ ভাগের প্রায় চার ভাগেই বাঁধ দিয়ে রাস্তা বানিয়ে বাকি এক ভাগে নিচু ও সংকীর্ণ সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এভাবে নদের বুকে বাঁধ দিয়ে রাস্তা বানানোর ফলে নদের প্রবাহও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। পলি জমে ভরাট প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছে। যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এবং নদী বিশেষজ্ঞদের মতে, সেতুগুলো দ্রুত অপসারণ করা না হলে নদী খননের সুফল পাওয়া যাবে না। জানা যায়, এসব সেতু অপসারণের জন্য যশোর পাউবোর পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে চিঠিও পাঠানো হয়েছে।
শুধু যশোরের ভৈরব নদে নয়, এমন অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বহু নমুনা সারা দেশেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। একবার প্রচুর অর্থ খরচের মাধ্যমে এসব সেতু বা বাঁধ নির্মাণ করা হয়, আবার সেগুলো গলার কাঁটা হয়ে গেলে বিপুল অর্থ ব্যয়ে অপসারণ করা হয়। সম্প্রতি প্রকাশিত আরেকটি খবরে দেখা যায়, কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত আড়িয়ালখাঁ নদকে মেরে ফেলা হয়েছে একের পর এক বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে। কাজের বিনিময়ে খাদ্য বা অন্যান্য ত্রাণ কর্মসূচির অর্থ দিয়ে কয়েক দশকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে এমন পাঁচটি বাঁধ তৈরি করা হয়েছিল। সম্প্রতি প্রশাসন সেগুলো অপসারণের কাজ শুরু করে।
এভাবে নদীর প্রবাহ বন্ধ করা দেশের প্রচলিত আইনেরও বিরুদ্ধে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! নিয়ম অনুযায়ী নদীর ওপর কোনো অবকাঠামো নির্মাণের আগে পাউবোর অনুমতি নেওয়া প্রয়োজন হলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা করা হয় না। আমরা আশা করি, ভৈরব নদের ওপর থাকা অসামঞ্জস্যপূর্ণ সেতুগুলো দ্রুত অপসারণ করা হবে এবং বিপুল অর্থ ব্যয়ে পরিচালিত খননকাজের শতভাগ সুফল নিশ্চিত করা হবে।