এ জীবনে নিশ্চয় অন্য এক স্বপ্ন দেখার সুযোগ ছিল তাঁর। দেখতেনও হয়তো। বয়সও তো খুব বেশি নয়। জীবনের অনেকটা সময় ছিল সামনে। কিন্তু জীবনটাকে নিছকই অন্য দশজনের মতো করে ভোগ করতে চাননি তিনি। তিনটি অবোধ শিশু রেললাইনের ওপর খেলছিল। কাছাকাছি চলে এসেছিল ট্রেন। তিন শিশুর জীবন বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করে উদাহরণ সৃষ্টি করে গেলেন নীলফামারীর সালমান ফারাজী শামীম। তিনি যে অন্যের বিপদে সব সময় ঝাঁপিয়ে পড়তেন, সেই গল্প এখন এলাকার মানুষের মুখে মুখে। গ্রামের কেউ অসুস্থ হওয়ার খবর এলেই তাঁকে নিয়ে ছুটতেন হাসপাতালে পরোপকারী এই যুবক। একসময় ঢাকায় এফডিসিতে চাকরি করতেন। চাকরির সুবাদে কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন। সেখান থেকে দুই বছর আগে বাড়ি এসে সংসার দেখাশোনা করছিলেন। এরই মধ্যে তাঁকে বউবাজারে রেলপথে সেতুর সংস্কারকাজ দেখাশোনার দায়িত্ব দেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বুধবার সকালে তিনি দায়িত্ব পালনে সেখানেই অবস্থান করছিলেন। আর তখনই ঘটে দুর্ঘটনা।
শামীমের বাবা নেই। বিধবা মা, স্ত্রী ও এক কন্যাসন্তানকে নিয়ে তাঁর সংসার। একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটির অভাব সেই সংসারটিকে এক চরম অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়েছে নিশ্চয়।
সালমান ফারাজী শামীম তিনটি শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করলেন এমন এক সময়ে, যখন সমাজ থেকে এ ধরনের উদাহরণ উঠে গেছে বললেই চলে। সমষ্টি থেকে সমাজ এখন অনেকটাই ব্যক্তিকেন্দ্রিকতায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে। এখানে পাশের বাড়ির মানুষটিকেও অনেকে চেনে না। অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যায় না কাউকে। উল্টো নিজেকে রক্ষা করে চলার প্রবণতাই এখন বেশি লক্ষণীয়। আমরা দেখতে পাচ্ছি, যৌথ পরিবার ভেঙে পরিবারগুলো টুকরা টুকরা হয়ে যাচ্ছে। মফস্বল শহরেও চলে গেছে অ্যাপার্টমেন্ট কালচার, যেখানে প্রতিবেশীর সঙ্গে বাক্যালাপ হয় না। ঠিক এমন একটি পরিবর্তিত সময়ের মুখে দাঁড়িয়ে সালমান ফারাজী শামীম প্রমাণ করলেন, মানুষ এখনো মরে যায়নি।
যে তিনটি শিশু রেললাইনে খেলছিল, তাদের মা-বাবাও সমাজে প্রতিষ্ঠিত কেউ নন। রিকশাচালক বাবা আর ফ্যাক্টরি শ্রমিক মা তিন সন্তানকে ঘরে রেখে অন্য দিনের মতো কাজে গিয়েছিলেন।
সালমান ফারাজী শামীম একটি উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। তাঁর পরিবারকে ১০ হাজার টাকা অর্থ সাহায্য করা হয়েছে। কিন্তু তিনি যে উদাহরণ সৃষ্টি করলেন, তা অমূল্য? তাঁর বিধবা মা, অকাল বিধবা স্ত্রী ও শিশুসন্তানটির কথা আমরা ভুলি কী করে। সমাজের জন্য পরোপকারী, সাহসী শামীমরাই আমাদের সমাজকে যুগে যুগে এগিয়ে নিয়ে যায়। আমরা শামীমকে কুর্নিশ জানাই। এমন আত্মত্যাগে মহিমান্বিত হয় পুরো সভ্যতা।