‘কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ’ বলে যে বাংলা প্রবাদটি আছে, সেটিই অক্ষরে অক্ষরে তামিল করল সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা পারফরম্যান্স বোনাস হাতিয়ে নিতে গ্রাহক তথা সাধারণ মানুষের সর্বনাশ করেছেন।
করোনাসংকটের কারণে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে মিটার রিডাররা গ্রাহকদের বাড়িতে গিয়ে মিটার পরীক্ষা করতে পারেননি। এই অবস্থায় বিদ্যুৎ বিভাগ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, পূর্ববর্তী কয়েক মাসের বিল গড় করে ওই দুই মাসের বিল নির্ধারণ করা হবে। গত সোমবার প্রথম আলোতে ‘কর্তাদের হুকুমে ভুতুড়ে বিল, শাস্তি কর্মীদের’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ভুতুড়ে বিল হওয়ার কথা স্বীকার করেন এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিপিডিসি তাদের ৩৬টি কার্যালয়ে চিঠি দিয়ে বেশি বিল করার নির্দেশ দিয়েছিল। ওই নির্দেশে এলাকাভেদে ১০ থেকে ৬১ শতাংশ বেশি বিল করতে বলা হয়।
কেবল করোনাকালেই নয়, বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থাগুলো অর্থবছরের শেষ দিকে আয় বেশি দেখানোর জন্য বরাবর বাড়তি বিল করে থাকে। এবার সেই বাড়তি বিলের পরিমাণ হয়েছে কয়েক গুণ। ফলে গ্রাহকেরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। ভুতুড়ে বিল নিয়ে অনেক গ্রাহক অভিযোগ করেছেন। আবার অনেকে প্রতিকার পাওয়া যাবে না ভেবে অভিযোগ করেননি। অন্যান্য বছরের ভুতুড়ে বিল যদি চুরি হয়ে থাকে, এবারেরটি হয়েছে ডাকাতি। কিন্তু ‘ডাকাতদের’ ধরবে কে?
বিদ্যুৎ সেবার মূল্য নির্ধারণ করার এখতিয়ার বিদ্যুৎ বিভাগ কিংবা বিতরণ সংস্থার নেই। গণশুনানির মাধ্যমে এটি করে থাকে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইঅারসি)। সংস্থাটি কথিত গণশুনানির নামে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে থাকে। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়ম–দুর্নীতি বন্ধে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। এটি দুর্ভাগ্যজনক।
ভুতুড়ে বিল যাঁরা করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কী ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়ে ডিপিডিসিসহ অন্য বিতরণ কোম্পানিকে চিঠি দিয়েছিল বিইআরসি। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত ডিপিডিসির চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ (এমডি) কেউই এই চিঠির জবাব দেননি। বিইআরসির আইন অনুযায়ী, অভিযোগের জবাব না দেওয়ার শাস্তি তিন বছরের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড। ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বিকাশ দেওয়ান চাকমা বাড়তি বিল করার নির্দেশনা দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন। তাহলে ডিপিডিসির আইসিটি বিভাগ থেকে কে চিঠি পাঠাল, সেটি তদন্ত হওয়া দরকার।
প্রতিমন্ত্রী ভুতুড়ে বিলের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। এটি যদি নিছক কথার কথা না হয়, তাহলে উচিত হবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনা। ভুতুড়ে বিলের বিষয়টি কয়েক মাস ধরেই আলোচনায়। অথচ কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বিদ্যুৎ খাতে ভুতুড়ে বিলই একমাত্র দুর্নীতি নয়, বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণেও ভয়াবহ দুর্নীতি ও অপচয় হয়ে আসছে। এসব চলতে দেওয়া যায় না।
বিদ্যুৎ বিভাগের অনিয়ম–দুর্নীতির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আমরা শুধু হুকুম পালনকারী কর্মীদের নয়, হুকুমদাতা কর্তাদের শাস্তির মুখোমুখি দেখতে চাই। একই সঙ্গে ভুতুড়ে বিল বাতিল করে নতুন করে গ্রাহকদের বিল পাঠাতে হবে। যাঁদের কাছ থেকে ইতিমধ্যে বেশি বিল আদায় করা হয়েছে, পরবর্তী মাসের বিলের সঙ্গে সেটি সমন্বয় করার দায়িত্ব বিতরণ সংস্থারই। মন্ত্রীর আশ্বাসের পর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়, আমরা তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছি।