বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে জীবনধারণ ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। এর একটি প্রধান কারণ লবণাক্ততার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। খাল-বিল, নদী-নালা, ডোবা, এমনকি ভূগর্ভস্থ পানিতেও মাত্রাতিরিক্ত লবণ ছড়িয়ে পড়ছে। বাগেরহাট জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ জানায়, উপকূলীয় এলাকায় প্রতি লিটার পানিতে লবণাক্ততার গ্রহণযোগ্য মাত্রা হচ্ছে এক হাজার মিলিগ্রাম। কিন্তু মোংলায় প্রতি লিটার পানিতে লবণাক্ততা পাওয়া যায় ৪ থেকে সাড়ে ৯ হাজার মিলিগ্রাম পর্যন্ত। অর্থাৎ স্বাভাবিকের চেয়ে ৯ গুণ বেশি। এসব পানি পান করে মানুষ উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, পেটের পীড়াসহ নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়ছে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে স্বাভাবিক জোয়ারও ক্রমে উপকূলের অনেক গভীরে থাকা লোকালয়ে প্রবেশ করছে। সমুদ্রের পানির এই অনুপ্রবেশ ভূপৃষ্ঠের পাশাপাশি ভূ-অভ্যন্তরেও লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়িয়ে চলেছে। ফলে দ্রুত বদলে যাচ্ছে উপকূলের পরিবেশ। মিঠা পানিনির্ভর উদ্ভিদ, মাছসহ জলজ প্রাণী মরে যাচ্ছে। ফসলের ধরন পাল্টে যাচ্ছে। মানুষেরও শারীরিক-মানসিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। কত দ্রুত লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়ছে তা জানা যায় একটি সমীক্ষা থেকে। ১৯৬২ সালে বাগেরহাটের মোংলা পয়েন্টে পশুর নদের পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ ছিল দুই পিপিটি (পার্টস পার থাউজেন্ড), ২০০৮ সালে সেখানে পাওয়া গেছে ২০ পিপিটি।
অথচ বিশুদ্ধ পানীয়জলে এটি থাকা প্রয়োজন শূন্য পিপিটি। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি স্থানীয় জনস্বাস্থ্যে ব্যাপক বিরূপ প্রভাব ফেলবে। তাঁদের মতে, মোংলার একজন মানুষ প্রতিদিন গড়ে দুই লিটার পানি পান করার মাধ্যমে প্রায় ১৬ গ্রাম লবণ গ্রহণ করছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। একজন মানুষের দৈনিক লবণ গ্রহণের পরিমাণ কোনোক্রমেই পাঁচ গ্রামের বেশি হওয়া উচিত নয়। শুধু অতিরিক্ত লবণই নয়, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মোংলায় পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আয়রন, আর্সেনিক ও ফ্লোরাইড পাওয়া গেছে।
উপকূলের অনেক মানুষ বড় মটকা বা অন্যান্য পাত্রে বর্ষার সময় বৃষ্টির পানি ধরে রেখে পরবর্তী সময়ে তা পান করে। কিন্তু সেই পানি দিয়ে সারা বছরের চাহিদা মেটানো সম্ভব হয় না। তা ছাড়া রান্নাবান্না, ধোয়া-মাজাসহ অন্যান্য কাজে নোনা পানিই ব্যবহার করা হয়। এভাবেও শরীরে লবণ গ্রহণের পরিমাণ বেড়ে যায়। অন্যদিকে গবাদি পশুকেও লবণাক্ত পানি পান করানো হয়। এতে গবাদি পশুরও স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি হয়। এসব কারণে লবণাক্ততা উপকূলীয় অঞ্চলে প্রধান সমস্যা হয়ে উঠেছে। বহু মানুষ উপকূল ছেড়ে অন্য এলাকায় চলে যাচ্ছে।
উপকূলে সুপেয় পানির সংকট কাটাতে সরকারিভাবে ১০ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানা গেছে। এটি অনুমোদনের পর দ্রুত বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। পাশাপাশি বৃষ্টির পানি ধরে রাখাসহ স্থানীয়ভাবে প্রচলিত লাগসই প্রযুক্তিগুলোর উন্নয়নে আরো জোর দিতে হবে।