পুরান ঢাকার দাহ্য রাসায়নিকের অব্যবস্থাপনার বিষয়টি একটি অমার্জনীয় ব্যর্থতার নজির হিসেবে টিকে আছে। সেখানকার রাসায়নিকের গুদামগুলো তদারকিহীনভাবে টিকিয়ে রাখার অভিঘাত ভয়াবহ। নিমতলী ও চুড়িহাট্টার দুটি রাসায়নিক বিপর্যয়ে প্রায় দুই শ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। রাষ্ট্র এ মৃত্যু বা ধ্বংসের দায় স্বীকার করেনি। আর এখন বিশেষজ্ঞরা একমত যে নিমতলী ও চুড়িহাট্টার মতো দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে।
প্রথমত সরকারি হিসাবেই ছোট–বড় মিলিয়ে বছরে অন্তত এক শ অগ্নিকাণ্ডের উৎস ওই দাহ্য রাসায়নিক। এসব দুর্ঘটনার আর্থিক ক্ষতি পরিমাপ করা হয় না। দ্বিতীয়ত, এগুলোর মজুত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যেহেতু অবৈধ, তাই এর রক্ষণাবেক্ষণে পারতপক্ষে কোনো স্বচ্ছতা বজায় রাখা হয় না। বরং বাস্তবে কী ঘটে, সেই অবস্থা এবার প্রত্যাশিতভাবে ফুটে উঠল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবির) প্রতিবেদনে। তিন শ টাকা থেকে আড়াই লাখ টাকার উৎকোচে টিকে আছে রাসায়নিকের অবৈধ স্থাপনা বা ব্যবসা। এটা পরিহাসের যে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর সবার বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর, বিস্ফোরক পরিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন—প্রতিটি প্রশাসনই যেন অর্থের কাছে নিজেদের বিকিয়ে দিয়ে চলেছে। বিশেষ করে এক দশক ধরে পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক স্থাপনা সরাতে কর্তৃপক্ষীয় সব উদ্যোগই কার্যত প্রশ্নবিদ্ধ। এখন প্রতীয়মান হয় যে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো, যারা রীতিমতো ‘ঘুষবাণিজ্য’ গড়ে তুলেছে, তারাই রাসায়নিক স্থানান্তরকে বাধাগ্রস্ত করতে কার্যকর ভূমিকা রেখে চলছে কিনা।
বিস্ফোরক অধিদপ্তরের কথাই ধরা যাক। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে চুড়িহাট্টার দুর্ঘটনার পরপরই তারা ৩৫টি ‘অতি দাহ্য’ রাসায়নিক স্থাপনা চিহ্নিত করেছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো এর সব কটিই যথাস্থানে টিকে আছে। টিআইবির রিপোর্ট থেকে আমরা দেখতে পাই, এ অধিদপ্তরের লোকেরাই সবচেয়ে বড় অঙ্কের উৎকোচ নিয়ে থাকেন।
২০১০ সালের নিমতলী থেকে গত বছরের চুড়িহাট্টা দুর্ঘটনার মধ্যবর্তী সময়ে বড় বড় প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এবং পুরান ঢাকাকে অবৈধ রাসায়নিক স্থাপনামুক্ত করতে দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিরা বড় বড় অঙ্গীকার করছেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, কোনো প্রকল্পের ক্ষেত্রেই কোনো অগ্রগতি নেই। বরং দীর্ঘসূত্রতার কারণে সাগরচুরির পথ প্রশস্ত হয়েছে। পুরান ঢাকার বিপজ্জনক রাসায়নিক মজুত সরিয়ে নিতেই ২০১১ সালে কেরানীগঞ্জে ২০ একর জমির ওপরে ৬৮৬ কোটি টাকায় প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। যথাসময়ে নির্মাণ শেষ হলে হয়তো চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি এড়ানো সম্ভব ছিল।
এটা প্রহসনমূলক যে কেরানীগঞ্জের ৬৮৬ কোটি টাকার প্রকল্প ৩৯ একরে সম্প্রসারণ এবং প্রকল্প খরচ চার গুণ বেড়েছে। আবার চুড়িহাট্টা দুর্ঘটনার পরে ঢাকার অদূরে দুটি পৃথক স্থানে দুটি ‘অস্থায়ী গুদামঘর’ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু গত দেড় বছরেও এগুলো বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়নি।
উল্লিখিত প্রেক্ষাপটে টিআইবির রিপোর্টকে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারকেরা একটি ওয়েকআপ কল হিসেবে দেখতে পারেন।
আমরা মনে করি, পুরান ঢাকা থেকে অবৈধ রাসায়নিক গুদাম স্থানান্তর সহজ হবে না। এটা করতে আরও সময় লাগবে। এটা নিন্দনীয় যে পারফিউম সমিতির একজন উপদেষ্টা দাবি করেছেন, পুরান ঢাকায় ‘দাহ্য বা অতি দাহ্য পদার্থের’ কোনো অস্তিত্ব নেই। এই মানসিকতা দুর্ভাগ্যজনক। এবং এটা নির্দেশ করে যে রাসায়নিক গুদামগুলোর মালিক এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যকার অশুভ রসায়ন শক্তিশালী। তাদের এ আঁতাতের ফলেই পুরান ঢাকার দাহ্য পদার্থের অস্তিত্ব আরও দীর্ঘকাল টিকে থাকতে পারে।
আমরা মনে করি, টিআইবির ১০টি সুপারিশ পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের উদ্যোগী হলে পুরান ঢাকার রাসায়নিক নিরাপত্তা বাড়বে। বিশেষ করে দ্রুততার সঙ্গে রাসায়নিক নিরাপত্তাবিষয়ক নির্দেশাবলি ও নীতিমালা তৈরি ও তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
সাবস্ক্রাইব
নিরাপদ নিউজ আইডি দিয়ে লগইন করুন
0 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরাতন