বিচিত্র রকম অপরাধের অবাধ চর্চার ক্ষেত্র হিসেবে ফরিদপুরের পরিচয় বিস্তৃত হয়ে চলেছে। সেখানে সর্বশেষ গ্রেপ্তার হয়েছেন যে তিনজন, তাঁদের একজন ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি নাজমুল ইসলাম খন্দকার (লেবি); দ্বিতীয়জন ফরিদপুর শ্রমিক লীগের নেতা বিল্লাল হোসেন এবং তৃতীয়জন ফরিদপুর শহর যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসিবুর রহমান (ফারহান)। গ্রেপ্তারকৃত এই ব্যক্তিদের সাংগঠনিক পরিচয় থেকেই স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, ফরিদপুরের অপরাধবৃত্তির মূল শক্তি কোথায় নিহিত রয়েছে।
শুধু এই তিনজন নন, গত ৭ জুন থেকে এ পর্যন্ত ফরিদপুরে নানা গুরুতর ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগে যে ১৬ ব্যক্তি গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন কিংবা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতায় নানা রকমের ফৌজদারি অপরাধে লিপ্ত থেকেছেন। তাঁদের মধ্যে সর্বাধিক চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী দুই সহোদরের একজন সাজ্জাদ হোসেন (বরকত) ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের একটি জেলা শহর শাখার সাধারণ সম্পাদক এবং তাঁর ছোট ভাই ইমতিয়াজ হোসেনের (রুবেল) বিরুদ্ধে দুই হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ গড়া ও অবৈধভাবে অর্থ পাচারের অভিযোগে মামলা দায়ের করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
শুধু তা-ই নয়, গ্রেপ্তারের পর বড় ভাই সাজ্জাদ হোসেন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে বলেছেন, ফরিদপুরে এলজিইডি, জনস্বাস্থ্য, সড়ক ও জনপদ, শিক্ষা প্রকৌশল, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিআইডব্লিউটিসি, গণপূর্ত, বিআরটিএ, বিদ্যুৎ অফিস, বিএডিসি, পাসপোর্ট অফিস ও শহরের ফুটপাত ছিল তাঁদের দুই ভাইয়ের নিয়ন্ত্রণে। তাঁরা সব ধরনের উন্নয়নকাজের ১৫ শতাংশ পেতেন।
সরকারি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার নিয়মকানুন অকার্যকর করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ার পাশাপাশি তাঁদের বিরুদ্ধে রয়েছে রোমহর্ষ সন্ত্রাসের অভিযোগ। ‘হেলমেট বাহিনী’ও ‘হাতুড়ি বাহিনী’র সন্ত্রাসের কাহিনিগুলো ফরিদপুরে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে কিংবদন্তির রূপ ধারণ করেছে। দুই সহোদরের ছোটজন ইমতিয়াজ হোসেন গ্রেপ্তারের পর পুলিশকে বলেছেন, তাঁদের আয়ের আরও একটি বড় উৎস ছিল অন্যের জমি অবৈধভাবে দখল করা ও চাঁদাবাজি। তাঁদের যে জমি পছন্দ হতো, সেটাই দখল করতেন।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, যে রাজনৈতিক ক্ষমতা এই সব অপরাধবৃত্তির শক্তি জুগিয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের সেই রাজনীতিও এই সব অপরাধপ্রবণ ব্যক্তির হাতে পর্যুদস্ত হয়েছে। ফরিদপুর আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে অপরাধী-সন্ত্রাসীদের হাতে; তাদের দৌরাত্ম্যে শহরছাড়া হয়েছেন দলটির ত্যাগী নেতারা। আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষও তাঁদের পাশে থাকেনি, সন্ত্রাসীদের পক্ষাবলম্বন করেছে।
ফরিদপুরের সাধারণ মানুষের অভিযোগ, সেখানকার সরকারি প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ সন্ত্রাসীদের শক্তি জুগিয়েছে। আওয়ামী লীগের একসময়ের নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের এবং তাঁদের গ্রেপ্তার করে দিনের পর দিন কারাগারে আটকে রাখার দৃষ্টান্তগুলো বাস্তবে সেই সাক্ষ্যই দেয়। নিরীহ সাধারণ মানুষও সন্ত্রাসীদের অত্যাচারের শিকার হয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শরণাপন্ন হয়ে প্রতিকার পায়নি—এমন অভিযোগও রয়েছে অনেক।
অপরাধক্ষেত্র হিসেবে ফরিদপুরের এই চিত্র বাংলাদেশের ব্যতিক্রমী বা বিচ্ছিন্ন চিত্র নয়—এমন কথা শুধু পর্যবেক্ষক মহলে নয়, সাধারণ মানুষের মুখেও উচ্চারিত হচ্ছে। বস্তুত ফরিদপুর বাংলাদেশের কোনো বিচ্ছিন্ন অঞ্চল নয়, সেখানে বছরের পর বছর ধরে এত বিচিত্র ধরনের ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত হতে পারলে দেশের অন্যান্য জেলায় তা অসম্ভব হওয়ার কথা নয়। সরকারি প্রশাসন ওই আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ নিজেদের দায়িত্ব পালন করলে এসব ঘটনা কোনোভাবেই সম্ভব নয়; কিন্তু তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালনও দুঃখজনকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতার ওপর।
ফরিদপুরে যে গ্রেপ্তার অভিযান এবং আইন প্রয়োগের জোরালো তৎপরতা চলছে, তা ফলপ্রসূ করতে হলে এই সব অপরাধবৃত্তির নেপথ্যের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার অবসান ঘটাতে হবে।