কামারখালী থেকে রাজবাড়ীর মোড়, মোটে ৩৩ কিলোমিটার রাস্তা। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের অন্তর্গত এই সামান্য রাস্তাটুকুতে গত ১৪ মাসে অন্তত ১৭টি বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে, ঝরে গেছে ৩৬টি অমূল্য প্রাণ, আর আহত যে কত হয়েছে, তার কোনো হিসাব আমাদের কাছে নেই। সত্য বটে, এই অল্প রাস্তাটুকুতেই আছে ১২টার মতো বাঁক, কিন্তু বাঁক নির্দেশ করার জন্য প্রতিটি জায়গাতেই তো আছে সাবধানতাসূচক সাইনবোর্ড। তার চেয়ে বড় কথা, বাঁকবহুল রাস্তা তো দুনিয়াতে আরও অনেকই আছে; কই, সেখানে তো এত লোক মারা যায় না। সত্য বটে, এই রাস্তাটুকুর মধ্যেই ৬ লিংক সড়ক এসে মহাসড়কটিতে উঠেছে, কিন্তু অধিকাংশ লিংক সড়ক থেকেই তো মহাসড়ক পরিষ্কার দেখা যায়, ফলে তাতে চলাচলকারী গাড়ি না দেখার কোনো কারণ তো নেই। আর এটা তো দুনিয়াজোড়া সর্বজনবিদিত রীতি যে সংযোগ সড়ক থেকে প্রধান সড়কে ওঠার আগে তার গতিবিধি ভালো করে লক্ষ করে, তারপর সাবধানে তাতে প্রবিষ্ট হতে হবে। তার চেয়ে বড় কথা, প্রকৌশলীরা বলছেন, নির্মাণজনিত কোনো ত্রুটি সড়কের ওই অংশটুকুতে নেই।
তাহলে অর্থহীন এসব প্রাণহানির কারণ কী? কারণ, আমাদের ট্রাফিক বিধি ভাঙার সংস্কৃতি, আমাদের প্রাণঘাতী ব্যস্ততা, ওভারটেকের প্রবণতা, সবার আগে যাওয়ার অশুভ মানসিকতা। তার চেয়ে বড় কথা, চালকেরা যে এখানে একে অন্যকে টপকানোর রেস করেন, সাইনবোর্ডগুলোকে বুড়ো আঙুল প্রদর্শন করেন, সংযোগ সড়ক থেকে বেপরোয়াভাবে গাড়ি নিয়ে প্রধান সড়কে উঠে আসেন, এসব দেখভাল করার সার্বক্ষণিক আইনি কোনো কর্তৃপক্ষই এখানে নেই। শত শত ট্রাফিক–অধ্যুষিত ঢাকা শহরেই যেখানে চালকদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না, সেখানে নজরদারি নেই, এমন একটা জায়গায় তারা কী করবে, তা সহজেই অনুমেয়।
তাহলে প্রতিকার কী? নিরীহ মানুষজন কি এভাবেই মরতে থাকবে? প্রশাসন বলছে, ঢাকার সঙ্গে খুলনাকে সংযুক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ এই সড়ক চার লেন করার পরিকল্পনা সরকারের আছে। চার লেন হলে দুর্ঘটনা এমনিতেই কমে যাবে। কিন্তু কবে পরিকল্পনা হবে, একনেকে অনুমোদন হবে, তারপর রাস্তা হবে—সে তো বহুদিনের মামলা, তত দিন কি এই মৃত্যুর মিছিল চলতেই থাকবে? মানুষজনের প্রাণ কি এতই সস্তা হয়ে গেল? স্থানীয় জনসাধারণ ও প্রকৌশলীরা বলছেন, অন্তর্বর্তী একটা উপায় হতে পারে সড়ক ডিভাইডার। মৃত্যুসড়কতুল্য ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বিপজ্জনক বাঁকগুলোতে ডিভাইডার বসানোর পর দুর্ঘটনা অনেক কমে গেছে। কামারখালী-রাজবাড়ী অংশটুকুতেও ডিভাইডার বসিয়েও কমিয়ে আনা যায় দুর্ঘটনার সংখ্যা। এই ৩৩ কিলোমিটার রাস্তায় ডিভাইডার বসাতে কত খরচ পড়বে, আমরা জানি না। তবে আরও ৩৬টি প্রাণের কাছে যে তা কিছুই না, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
কিন্তু এসবই তো আমাদের মূল্যমান। কর্তৃপক্ষের কাছে এই সব প্রাণের মূল্য কি আদৌ আছে?