চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে গত শনিবার রাতে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় গত মঙ্গলবার রাতে মামলা করেছে পুলিশ। মামলায় আসামি হিসেবে ডিপোতে সে সময় কর্মরত আটজন কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে একটি বড় অভিযোগ, তাঁরা ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের ডিপোতে ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিকদ্রব্য থাকার কথা জানাননি। ফলে রাসায়নিকদ্রব্যের বিস্ফোরণে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরাও হতাহত হয়েছেন।
এই মামলায় মালিকপক্ষের কাউকে এখন পর্যন্ত আসামি করা হয়নি। মামলাটির তদন্ত শুরু হয়েছে।
ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডের পর থেকেই গণমাধ্যমে নানা রকম খবর আসছে। আর সেসব খবর থেকে জানা যাচ্ছে, কনটেইনার ডিপো ও রাসায়নিকের কারখানা ঘিরে চলেছে বহু অনিয়মের ঘটনা। জননিরাপত্তার প্রতি হুমকি, এমনকি পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য দায়ী এসব কর্মকাণ্ড দীর্ঘ সময় ধরে নির্বিঘ্নে চলে আসছে। তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব যেসব সরকারি সংস্থার ওপর ছিল, তারাও কোনো বিশেষ কারণে এসব দেখেনি।
প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, কনটেইনার ডিপোর অগ্নিকাণ্ড ভয়াবহ রূপ নেয় হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ভর্তি কনটেইনার বিস্ফোরণের কারণে। এই রাসায়নিক দ্রব্যটি উৎপাদন করে আল রাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্স নামের একটি কারখানা। কারখানাটি হাটহাজারী উপজেলার সীমান্তে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডের পাহাড়ঘেরা ঠাণ্ডাছড়ি এলাকায় অবস্থিত।
এর একটি অংশ টিলা ও পাহাড় কেটে বানানো হয়েছে। এ জন্য ২০১৯ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছয় লাখ ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছিল। খতিয়ানে পাহাড়ের উল্লেখ থাকায় আইন অনুযায়ী সেখানে এ ধরনের কারখানা স্থাপনের অনুমতি দেওয়া যায় না। তার পরও তারা অনুমতি পেয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরও ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি কারখানাটিকে পরিবেশ ছাড়পত্র দিয়েছিল। কিন্তু বর্জ্য শোধনাগার বা ইটিপি স্থাপন না করায় ২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ছাড়পত্রের মেয়াদ শেষ হলে আর তা নবায়ন করা হয়নি।
এর পর থেকে কারখানাটি পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই চলে আসছিল। তার পরও পরিবেশ অধিদপ্তর কারখানাটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কারখানাটির বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য ছড়া বা খাল বেয়ে গিয়ে পড়ছে বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননকেন্দ্র হালদা নদীতে। ফলে মাছ, ডলফিনসহ বহু জলজ প্রাণীর মৃত্যু হচ্ছে। বিষয়টি বহুবার পরিবেশ অধিদপ্তরকে জানানো হলেও তা বন্ধ হয়নি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতির শর্তে বলা ছিল, আল রাজি কারখানায় বছরে এক হাজার টন হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড উৎপাদন করা যাবে। সেই হিসাবে দুই বছরে সর্বোচ্চ দুই হাজার টন উৎপাদনের কথা। অথচ দুই বছরে রপ্তানিই করা হয়েছে আট হাজার ৬৬২ টন হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড। অর্থাৎ পদে পদে নিয়ম লঙ্ঘন হয়েছে।
অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণে এ পর্যন্ত ৪৬ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। এই হতাহতের দায় কে নেবে? ডিপো ও কারখানা দুটির মালিকরা কি এ জন্য দায়ী নন? পরিবেশ ছাড়পত্র নবায়ন করা হয়নি বললেই কি পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্তাব্যক্তিরা দায় এড়াতে পারবেন? আমরা চাই, সব অনিয়ম তদন্ত করা হোক এবং দায়ী সবার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক।