ইয়ারফোনে গান শোনা অবস্থায় আবারও ট্রেন চাপা পড়ে মারা গেলেন ফরিদপুরের তরুণ শিপন পাল। খুব বেশি দিন হয়নি, ১৯ ডিসেম্বর ঠিক এই কাজ করতে গিয়েই মারা গেছে নরসিংদীর কিশোর দ্বীন ইসলাম। একটু খোঁজাখুঁজি করলেই উদাহরণ আরও দীর্ঘ করা যায়। তারপরও পূর্ণাঙ্গ হিসাব একে বলা যাবে না। কারণ, সব দুর্ঘটনার খবর পত্রিকা পর্যন্ত আসে না। এসব অর্থহীন মৃত্যু আমাদের একধরনের নিরুপায় ক্রোধে আক্রান্ত করে।
চলন্ত ট্রেনের পাশে জীবনে একবারও যে দাঁড়িয়েছে, সে–ই জানে কী প্রচণ্ড শব্দ ইঞ্জিনটা করে। তারপর আবার রেললাইনে কাউকে দেখলে দূর থেকেই হর্ন বাজাতে থাকেন চালক, তারপরও কী করে এতটা বেখেয়াল থাকতে পারে মানুষ, কী করে টের পায় না। কতটা উঁচু ভলিউমে গান শুনলে আশপাশের শব্দ সম্পর্কে এতটা বধির হওয়া যায়। আর এত উঁচু ভলিউমে গান শোনার জন্য রেললাইনকেই কেন বেছে নিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে রেললাইনে আমরা কী কী করি, তার একটা ফিরিস্তি দেওয়া যায়। রেললাইনে বসে আমরা প্রেম করি, শীতকালে রোদ পোহাই, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারি, ঝগড়া করি, বাজার বসাই, প্রাকৃতিক ক্রিয়াকর্ম সারি, হাঁটাহাঁটি করি আর কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনি। তালিকাটা দেখলে বিস্মিত হয়ে যেতে পারে অন্য যেকোনো দেশের রেল মন্ত্রণালয়। ট্রেন আসার সংকেত পড়েছে, ক্রসিংয়ে প্রতিবন্ধক ফেলা হয়ে গেছে, ঠিক এই সময়ে আমাদের কিছু জ্ঞাতিভাইয়ের কর্মব্যস্ততা কাজপাগল জাপানিদেরও লজ্জা দেবে। জেব্রা বা রেলক্রসিংজাতীয় জায়গায় এলেই যেন তঁাদের মনে পড়ে যায় সময় বড় কম, মূল্যবান এই বস্তুটাকে বাঁচাতে প্রয়োজনে তাই জীবনটাকেই তুচ্ছ করতে হবে।
সারা দেশে রেললাইন আছে কমবেশি ৩ হাজার ৬০০ কিলোমিটার। এত লম্বা জায়গা পাহারা দিয়ে রাখা বা পর্যবেক্ষণের আওতায় আনা আমাদের কেন, যেকোনো সরকারের পক্ষেই দুঃসাধ্য। সচেতনতাই কেবল ঠেকাতে পারে এসব দুর্ঘটনা। আরেকটা বিষয়ও ভাবার আছে, এত জায়গা থাকতে মানুষ কেন লাইনে গিয়ে আড্ডা মারে, গান শোনে। অবসর বিনোদনের উপযোগী খোলা জায়গা, পার্ক, মাঠ আমাদের খুব কম কিংবা থাকলেও দখল হয়ে আছে, পরোক্ষে এ সমস্যাটার দিকেও হয়তো আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে এসব মৃত্যু। ফরিদপুরের এই তরুণও ছিলেন বস্তির বাসিন্দা। নিরিবিলি একটু গান শুনবেন, তেমন জায়গা আশপাশে হয়তো রেললাইন ছাড়া ছিল না। কিন্তু এ সমস্যার সমাধান তো শিগগিরই হবে না, আমাদের জানের জিম্মাদার তাই আমাদেরই হতে হবে।