মানুষের মধ্য থেকে সুবিবেচনা, নীতিনৈতিকতা ও মানবিক গুণাবলি ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। উল্টো দিকে বাড়ছে অনৈতিকতা, অপরাধ তৎপরতা ও নিষ্ঠুরতা। খুন, ধর্ষণ যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে শিশু হত্যার ঘটনাও। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে সদ্যোজাত শিশু বা নবজাতক হত্যার ঘটনাও দ্রুত বাড়ছে। শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, গত ছয় বছরে রাজধানীতে উদ্ধার করা হয় ২১০টি নবজাতকের লাশ। এর মধ্যে শুধু গত ডিসেম্বর মাসেই রাজধানীতে অন্তত ২০টি নবজাতকের লাশ উদ্ধার করা হয়। রাস্তাঘাট, ঝোপঝাড়, ফুটপাত, ডাস্টবিন, শৌচাগার বা নালা-নর্দমায় এসব নবজাতককে ফেলে দেওয়া হয়। এর মধ্যে কিছু পরিত্যক্ত নবজাতককে জীবিত উদ্ধার করা গেলেও বেশির ভাগকেই পাওয়া যায় মৃত অবস্থায়। আইনজীবীদের মতে, এগুলো অতি নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড। তা সত্ত্বেও বেশির ভাগ হত্যাকারীই থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা এ জন্য দেশে ডিএনএ ব্যাংক না থাকা এবং হত্যাকারীদের ধরার ক্ষেত্রে পুলিশের অবহেলাকেই বেশি দায়ী করছেন।
সমাজবিজ্ঞানী, মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীরা বলছেন, সচেতনতার অভাবে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ সন্তান জন্ম নিচ্ছে। পরে লোকলজ্জার ভয়ে তাদের হত্যা করা হচ্ছে। পারিবারিক অনুশাসন ঢিলে হয়ে পড়া এবং এমন জঘন্য অপরাধ করার পরও শাস্তি না হওয়ায় ক্রমেই বাড়ছে এ ধরনের অপরাধের সংখ্যা। এই সামাজিক অপরাধ প্রতিরোধে কার্যকর তদন্ত ও অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ও পুলিশের মতে, এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নবজাতকের মা-বাবা, তাদের পরিবার এবং কিছু মেটারনিটি ক্লিনিকের কর্মী জড়িত। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যেসব নবজাতক ভাগ্যগুণে বেঁচে যায়, তারা নিঃসন্তান মা-বাবার কাছে আদরে বেড়ে উঠছে। সন্তান দত্তক নিতেও উত্সুক বহু পরিবার।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের ছোটমণি নিবাসসহ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব নিয়ে এসব শিশুর লালন-পালন করছে। তার পরও এমন নিষ্ঠুরতা কেন? শুধু লোকলজ্জার ভয়ে সদ্য পৃথিবীতে আসা কোনো নবজাতকের প্রাণ কেড়ে নিতে যাদের হাত কাঁপে না, অন্য বড় অপরাধ করতেও তাদের হাত কাঁপবে না। যাদের এত লোকলজ্জা, তারা আগে সাবধান হয় না কেন?
নবজাতক হত্যার ঘটনা উন্নত দেশেও ঘটে থাকে। কিন্তু ডিএনএ ব্যাংক থাকায় তারা সহজেই নবজাতকের ডিএনএ মিলিয়ে হত্যাকারীদের শনাক্ত করতে পারে এবং বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে পারে।
ফলে সেসব দেশে এমন হত্যাকাণ্ড কমই ঘটে। আমাদের দেশেও ডিএনএ ব্যাংক গড়ে তোলা জরুরি। তাতে শুধু নবজাতক হত্যাই নয়, আরো অনেক অপরাধ দ্রুত তদন্ত করা যাবে। নবজাতক হত্যার সঙ্গে মা-বাবা, তাদের পরিবার, ক্লিনিক বা ধাত্রী—যারাই জড়িত থাক না কেন, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তদন্তে অবহেলা থাকলে তদন্ত সংশ্লিষ্টদেরও বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।