চট্টগ্রামকে বলা হয় দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী বা অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। আর চট্টগ্রামের এমন গুরুত্বের পেছনে রয়েছে সমুদ্রবন্দর ও কর্ণফুলী নদীর অস্তিত্ব। মোহনার নদী হিসেবে কর্ণফুলীর মাধ্যমে সমুদ্র পরিবহনের যে সুবিধা তৈরি হয়েছে তার কারণেই চট্টগ্রাম বিশেষ ভৌগোলিক গুরুত্ব পেয়েছে। তাই বলা যায়, কর্ণফুলী বাঁচলে চট্টগ্রাম বাঁচবে।
আর কর্ণফুলী না বাঁচলে চট্টগ্রামও বাঁচবে না। অথচ বাস্তবে সেই কর্ণফুলীর আজ মরণদশা। দখল, দূষণ ও বর্জ্য ফেলে নদী ভরাটের কারণে কর্ণফুলীর মরণদশা দ্রুত এগিয়ে চলেছে। নদীতে ড্রেজিং করতে গিয়ে দেখা গেছে, এর তলদেশে ৬০ ফুট পর্যন্ত পলিথিনের স্তর জমা হয়েছে, যা তুলে আনাও এক দুরূহ কাজ। তার পরও প্রতিনিয়ত শিল্প ও গৃহস্থালি বর্জ্য গিয়ে পড়ছে নদীতে। এ অবস্থায় নদী রক্ষায় জরুরি উদ্যোগ নিতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) ২০১৮-১৯ সালের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, বন্দরনগরীতে দৈনিক বর্জ্য উৎপাদিত হয় তিন হাজার টন। এর প্রায় পুরোটাই গিয়ে পড়ে কর্ণফুলী নদীতে। সেই বর্জ্যের ৮.৩ শতাংশই হচ্ছে প্লাস্টিক-পলিথিন। সেই হিসাবে নগরীতে প্রতিদিন অপচনশীল এই বর্জ্য তৈরি হয় ২৪৯ টন।
প্রতিনিয়ত বর্জ্যের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। নদীর তলদেশে জমা হওয়া ৬০ ফুট পুরু এই বর্জ্যের স্তরের কারণে ভূগর্ভে পানি প্রবেশও ব্যাহত হচ্ছে। নদীর তলদেশ থেকে এই প্লাস্টিক বর্জ্য আগে সরাতে হবে, তারপর ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদী নাব্য করতে হবে। তা না হলে নদীতে নৌপরিবহন ব্যাহত হবে। আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হবে। একই সঙ্গে নদীতে প্লাস্টিক-পলিথিনসহ সব ধরনের বর্জ্য ফেলা বন্ধ করতে হবে। সেটি কিভাবে করা হবে দ্রুত তার পরিকল্পনা করতে হবে এবং সেই পরিকল্পনা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সিটি করপোরেশন বা সরকারের পক্ষ থেকে এসব বর্জ্য সংগ্রহ ও রিসাইক্লিংয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
শুধু চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নয়, সারা দেশেই নদীগুলো মেরে ফেলা হচ্ছে। অথচ সরকারের ডেল্টা পরিকল্পনায় নদী রক্ষায় অনেক উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে। উচ্চ আদালত থেকে নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে নদী রক্ষায় বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নদী রক্ষা কমিশন দখলকারীদের তালিকা প্রণয়নসহ নদী রক্ষায় বহুবিধ কর্মসূচি গ্রহণের সুপারিশ করেছে। কিন্তু সেসবের বাস্তবায়নের ধীরগতি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। উল্টো এখনো অনেক সিটি করপোরেশনই ট্রাকে করে বর্জ্য নিয়ে নদীতে ফেলে। এখনো স্থায়ীভাবে নদীর সীমানা চিহ্নিত করার কাজ সম্পন্ন হয়নি। তীর সংরক্ষণ, ওয়াকওয়ে নির্মাণ, বনায়নসহ অন্যান্য নির্দেশনা সঠিকভাবে মানা হচ্ছে না।
বাংলাদেশ নদীবিধৌত পলিমাটির দেশ। নদীর অস্তিত্বের ওপরই বাংলাদেশের অস্তিত্ব নির্ভর করে। আর বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রামের অস্তিত্ব প্রায় পুরোপুরি নির্ভরশীল কর্ণফুলী নদীর কার্যকর অস্তিত্বের ওপর। আমরা আশা করি কর্ণফুলীর অস্তিত্ব রক্ষায় দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। নদীতে বর্জ্য ফেলা বন্ধ করা হবে।