বাংলাদেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ। এ দেশের নদীগুলোকে কেন্দ্র করেই একসময় গড়ে উঠেছিল বড় বড় বাণিজ্যিক কেন্দ্র। কিন্তু এখন দেশের অনেক নদীই হারিয়ে গেছে। অনেক নদী মৃতপ্রায়। নগর সভ্যতা আর বাণিজ্যের প্রাণ যে নদী, সেই নদীতে আজ দখলদারদের নজর পড়েছে। একসময় বড় বড় কলকারখানা গড়ে উঠেছিল যে নদীর পারে, সেই নদীগুলো চলে যাচ্ছে অন্যের দখলে। দূষণ বাড়ছে। নদীর সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশের নদীগুলোতে একসময় মাছের প্রাচুর্য ছিল।
নদীর সেই মৎস্যসম্পদ হারিয়ে গেছে। নদীর পারে গড়ে ওঠা কলকারখানার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীতে। কোনো কোনো বড় প্রতিষ্ঠান নদীর জমি দখল করে গড়ে তুলেছে অবৈধ ভবনও। অবৈধভাবে দখল করা নদীর জমিতে এসব প্রতিষ্ঠান নিজেদের সুবিধার জন্য রাস্তা বানিয়েছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন এসব অবৈধ দখলবাজকে উচ্ছেদ করার নির্দেশনা দিলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অনেক নদী দখলমুক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রভাবশালী মহল কিভাবে নদী গিলে খাচ্ছে, নিজেদের ব্যাবসায়িক স্বার্থে নদীর জমি অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে, তা উঠে এসেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে।
পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, কৃষি, জীবনযাপন—সব কিছুর সঙ্গে নদীর সম্পর্ক। পরিবেশকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন, নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে। নদী-জলাশয় রক্ষায় আইন থাকলেও আইনের বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে। দখল-দূষণ রোধ করা, নিয়মিত খননের মাধ্যমে নদীগুলোকে নাব্য রাখা, দখল, দূষণ ও ভরাটকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া, নদীগুলোর সীমানা স্থায়ীভাবে চিহ্নিত করা—কোনো কাজই সঠিকভাবে করা হচ্ছে না।
এমনকি এ ব্যাপারে আদালতের নির্দেশও যথাযথভাবে পালন করা হচ্ছে না। নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রকৃতি-পরিবেশ ক্রমেই বদলে যাচ্ছে। নদীভিত্তিক যোগাযোগব্যবস্থায় রীতিমতো ধস নেমেছে। হাইকোর্টের এক যুগান্তকারী রায়ে দেশের সব নদ-নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করা হয়েছিল। নদী সুরক্ষায় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে আইনগত অভিভাবক ঘোষণা করে ১৭ দফা নির্দেশনা প্রদান করা হয় ওই রায়ে।
নির্দেশনায় বলা হয়, কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নদী দখল ও দূষণের অভিযোগ থাকলে সেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ব্যাংকঋণ পাওয়ার অযোগ্য হবে এবং এই মর্মে প্রয়োজনীয় নির্দেশনাসহ বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের সব তফসিলি ব্যাংককে সার্কুলার পাঠাবে। রায়ে আরো বলা হয়, নদী দখল ও দূষণকারী ব্যক্তিরা দেশের সব ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা, জেলা পরিষদ এবং জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা হারাবেন।
১৯৭৫ সালে আমাদের দেশে নদীপথ ছিল ২৪ হাজার কিলোমিটার। বর্তমানে তা কমে এসেছে ছয় হাজার কিলোমিটারে। শুষ্ক মৌসুমে এই পথ আরো কমে যায়। এসব নদীর নাব্যতাও কমে যাচ্ছে। তার ওপর যদি এভাবে দখল চলতে থাকে, তাহলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে সব নদীপথ। কাজেই নদী দখল রোধ করতে হবে। অবৈধ দখলদারদের অবিলম্বে উচ্ছেদ করতে হবে।