১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট দিনাজপুরে ইয়াসমিন নামের এক কিশোরী ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছিল। সেই ঘটনার স্মরণে বাংলাদেশ প্রতিবছরের ২৪ আগস্ট নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। নারী নির্যাতন এবং ধর্ষণের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে সামাজিক জাগরণ তৈরি করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য।
ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা মামলার ঘটনায় দেশব্যাপী আন্দোলন এবং অভিযুক্ত তিন পুলিশ সদস্যের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল। কিন্তু ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার অপরাধীদের শাস্তি কি সমাজে নারী ধর্ষণ ও হত্যা কমাতে পেরেছে? এর সরল উত্তর—পারেনি। ২৪ আগস্ট প্রকাশিত খবরের শিরোনাম ছিল ‘তিন বছরে ধর্ষণ বেড়েছে ১২২ শতাংশ’। বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুসারে, অস্বাভাবিক হারে গত তিন বছরে ধর্ষণ বেড়েছে। ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২০ সালে ধর্ষণ বেড়েছে ১২২ শতাংশ। ২০১৮ সালে ৭৩২, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ এবং ২০২০ সালে ১ হাজার ৬২৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।
করোনাকালে জনজীবন স্বাভাবিক ছিল না। মানুষ প্রায় ঘরবন্দী ছিল। স্বাভাবিকভাবে এ সময় নারীর ওপর সহিংসতাও কম হওয়ার কথা। কিন্তু পরিসংখ্যানমতে, এ সময়ই নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে বেশি। নারী নির্যাতন ও সহিংসতা বন্ধে দেশে কঠোর আইন আছে। ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে ২০২০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সংশোধন আনা হয়েছে। এরপরও ধর্ষণ কমেনি। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও এই অপরাধে জড়িত হয়ে পড়ছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালে ৪ জন, ২০১৯ সালে ৩ জন, ২০২০ সালে ৪ জন এবং চলতি বছরের এখন পর্যন্ত ৪ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়েছে।
এ বছরের মে মাসে ভারত থেকে দেশে ফেরা এক নারী খুলনার একটি আইসোলেশন কেন্দ্রে কোয়ারেন্টিনে থাকার সময় এক পুলিশ সদস্যের ধর্ষণের শিকার হন। ওই পুলিশ সদস্য খুলনা জেলা কারাগারে আছেন। এই মামলায় এখনো অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি। ২০১৮ সালে ৩০ ডিসেম্বর রাতে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে চার সন্তানের মা ধর্ষণের ঘটনায় আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হলেও সওয়াল-জবাব নেওয়া যায়নি করোনার কারণে। এ রকম ধর্ষণের বহু মামলা ঝুলে আছে।
দেশে যে ধর্ষণের ঘটনা ভয়াবহ মাত্রায় বেড়ে গেছে সংবাদমাধ্যমের পরিসংখ্যান দিয়ে সব পুরো চিত্র পাওয়া যাবে না। সব ধর্ষণের ঘটনায় মামলাও হয় না। আর সাজার হার মাত্র ৩-৪ শতাংশ। বাকিরা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসেন। অনেক সময় ক্ষমতা, অর্থ ও প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে এসব ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হয়। নির্মম বাস্তবতা হলো, সমাজে যাঁরা ধর্ষণের শিকার হন, তাঁরা ভয়ভীতির মধ্যে থাকেন। আর ধর্ষকেরা আস্ফালন করে থাকে। মনে রাখতে হবে, নারী নির্যাতন ও ধর্ষণবিরোধী কঠোর আইনই যথেষ্ট নয়; সেই আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। মামলা করতে গিয়ে ভুক্তভোগী নারী যাতে হয়রানি ও সামাজিক হেনস্তার শিকার না হন, তারও নিশ্চয়তা থাকতে হবে। ইয়াসমিনের মা যথার্থই বলেছেন, ‘অপরাধীদের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দিতে হবে।’